আগের ব্লগে একটি পাঠ অভিজ্ঞতায় বেশ আনন্দ পেয়েছি। সেখানে চারটি প্রশ্নের মোড়কে দুটি খুব গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন ছিল। এবং সেই দুটি প্রশ্ন আরও বেশ কিছু কথার দাবি রাখে। উদ্ধৃতিসহ সেগুলো এখানে তুলে দিলাম তাই-
আচ্ছা! সহজ করেও তো বলা যায়, তাহলে এত বাক্য জাল সৃষ্টি করার কী প্রয়োজন!?
সহজ লেখা কী আজকালকার পাঠক অপছন্দ করে?
বই লেখার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিৎ? আমি কত জানি সেটা দেখানো নাকি আমি কী জানাতে চাইছি সেটা দেখানো?
প্রশ্নগুলির ভিতরের উদ্দেশ, প্রয়োজন ইত্যাদি খুঁটিনাটি কৌতূহলের কোনো তাগিদ আমার অনুভব হয়নি, কারণ এগুলি যথেষ্ট সাবলীল এবং সাধারণ চিন্তা যা কেবল তাঁর মধ্যেই এসেছে এমনটা নয়, এই একই কথা অন্য অনেকের মাথাতেও যে চলে এই নিয়ে আজ এত কথোপকথনের পর সত্যিই কোনো সন্দেহ নেই। যিনি প্রশ্নটা করেছিলেন, তাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি, তাঁর পেশার প্রতি মানুষের আস্থা আছে; ফলে উত্তর দিতে কোনো কুণ্ঠা করিনি।
“দেশ আকাশের পর্যায়বাচী শব্দ। আকাশের পর্যায়বাচক হৃদয়” হয়ত এই বাক্যদুটির কারণেই প্রশ্নগুলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যার কথা সবার আগে মনে পড়েছে তিনি হলেন বাদরায়ণ। আমি তার প্রকৃত পরিচয় জানি না। পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি তিনি প্রাচীন বদরিকা আশ্রমের কেউ। ব্রহ্মসূত্র তাঁর রচনা। লোকে তাকে আবার বেদব্যাসও বলে থাকেন। এত সহজে মহাভারত লিখলেন, অথচ ব্রহ্মসূত্রের বেলায় এরকম করা একদমই তাঁর উচিত হয়নি। যাই হোক, এটা মজার ছলেই বললাম। সনাতনীরা আবার যেন রাগ না করে বসেন। কিন্তু সহজ করে বলা বলতে আমরা ঠিক কি আশা করি? এমন কিছু যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য? যা মোটামুটি চোখ কান নাকের অভিজ্ঞতায় জেনে যাওয়া যায়? তাহলে যা এইসবের অতীত যাকে কেবলই অনুভব করা যায়, যাকে প্রত্যক্ষে পাওয়া যায় না, তাঁর কাছে যাব কোন উপায়ে? তাঁর জন্যেই কি ললিতকলার প্রয়োজন না?
আরেকটু খোলসা করলে বিষয়টির বিপ্রতীপ একটি নন্দনতত্ত্বের কথা বলতে হয়। মার্ক্সিস্ট ক্রিটিসজম যা কিনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের বাইরের যা কিছু তাকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ সাব্জেক্টিভ যা কিছু তার কোনই অস্তিত্ব তার কাছে নেই। তাই তার শিল্পের বিষয় কখনই অলৌকিক হতে পারে না। তা সমস্তকিছুকেই আপনার বুদ্ধির আতশকাচে ফেলে কাটাছেঁড়া করতে শেখাবে। আপনি যদি কাটাছেঁড়া করতে পারেন তাহলে সেই বিষয়গুলি সহজ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু যে বিষয়গুলি নিয়ে কাটাছেঁড়া করার পরিসর কম? সেইগুলি?
এখানে একটি বিশেষ নন্দনতত্ত্বের কথা উল্লেখ করার মূল প্রয়োজনটাই হচ্ছে যেকোনো পাঠকে সমালোচনা করার একটা বিশেষ উপায় আছে। সাহিত্যের বা শিল্পের ছাত্রছাত্রীমাত্রই তাকে সেটি জানতে হয়, বা যারা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী নন, তারা ধরে নিন যে জানানো হয়। নইলে কোনো বিশেষ শিল্পকর্মকে যথাযথ অনুধাবন করা যায় না, এইরকম একটা বিশ্বাসও প্রচলিত। আজকাল ইউটিউব বা ইন্সটারিলের সৌজন্যে যা এক্কেবারেই হারিয়ে গেছে; একটি সিনেমা রিলিজ করলে, বা একটি বই প্রকাশিত হলে আমরা হয় তাকে ভালো বলি, নইলে তাকে এমন একটি যা ইচ্ছা তাই উপায় সমালোচনা করি, যে তারপর তাকে ‘বয়কট’ করা ছাড়া উপায় থাকে না। এবং সত্যিই সেই সমালোচনা বা ক্রিটিসিজমের কোনো মাথামুণ্ডু বা যৌক্তিক বিশ্লেষণ আমি দেখতে পাই না। আগেও যে এটি হতো না তা নয়। কিন্তু আজকাল মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার সাধন বেড়েছে। সংজ্ঞাহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রযুক্তির ব্যবহার সমষ্টির কাছে হয়ে উঠেছে ক্ষতিকর। একজন ছাত্রকে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করতে বছরের পর বছর নিজের ধৈর্য ও সহ্যশক্তির পরীক্ষা দিতে হতো, সেখানে তো আজ বিনা সার্টিফিকেটে শিক্ষক হয়ে ওঠা যায় কোটি কোটি টাকার ভ্যালুয়েশনে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাঘকে সার্কাসে খেলা দেখাতে ছেড়ে দেওয়ার সমান বলেই আমার তা মনে হয়। পাগলের হাতে আপনি তুলে দিলেন লোডেড একটি বন্দুক যেমন। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া আছে, তাই আমাদের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আজ আর কোনো প্রয়োজন নেই। যাই হোক আলোচনা আর অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক না। এখনই আমি আবার তাঁর প্রথম প্রশ্নের বিরুদ্ধাচারণ করছি। ‘এত বাক্যজাল সৃষ্টি করার কী প্রয়োজন’?
ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব লৌকিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো কিছুকে তাঁর বিষয় বলে মানতে রাজি নয়। ইন্দ্রিয়কে বরং সাধন করে যা ইন্দ্রিয়াতীত তাকে ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টা, এই ভারতের অভিপ্রায়। ভারতীয় নাট্য তাই দশলৌকিক পদার্থ ও পঞ্চলৌকিক জ্ঞানের বাইরের জিনিস। আমরা তাই স্পেসটাইম এই শব্দদুটি বোঝাতে ব্যবহার করি দেশকাল, দেশ যেখানে কোনো সীমিত একটি মানচিত্র নয়, বরং নিজেই একটা গোটা আকাশ, আর কাল মানে ইতিবৃত্ত থেকে খণ্ডিত কোনো বিশেষ মুহূর্ত নয়, বরং সেই আকাশের ব্যাপ্তি। এবং সেই কারণেই ভারতবর্ষে চক্রবর্তী সম্রাট সহস্রবছর রাজত্ব করতেন। সহস্র অর্থাৎ যা অম্নিপ্রেসেন্ট। আর আমাদের হৃদয়কেও তাই আকাশ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। আমি কথাটিকে নাম দেওয়া হয়েছে অহম। এই যে ‘দশরথ সহস্রবছর রাজত্ব করলেন’, এই কথটির আসল ব্যুৎপত্তি তখনই অনুধাবন করা যাবে যখন আমি এই উদ্ধৃতির শব্দগুলির সঙ্গে পরিচিত হব। আমরা এই সবকিছুই জেনেছি অনুবাদে। দশ ইন্দ্রিয় দ্বারা নির্মিত রথ তাঁর সওয়ারি আত্মারামকে বনবাসে পাঠালেন নিছক প্ররোচনায় এই কথা নিজেদের ভাষাজ্ঞানে জেনেছি কই। আরও উদাহরণে হয়তো বিষয়টি আরও সহজ হবে। কিন্তু পাঠক লেখাই পছন্দ করেন না, মেড-ইজিসহ লিখে তাকে তবে বড় করা কেন! এই তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্নের উত্তর এখনও বাকি আছে, অপেক্ষা করুন।
অতএব সকলেই লেখক নন। অন্তত আমি তা বিশ্বাস করিনা এবং কেন করিনা সেই কথাটি আগের ব্লগেই লিখেছি। তাই বই লেখার উদ্দেশ্যই আমার কাছে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। এখন সচেতন শব্দটিকেও আমরা ইংরেজি অ্যাওয়ারনেস-এর অনুবাদে যদি বুঝি তাহলে ভুল হবে। সবচেয়ে কাছের শব্দ বোধ হয়, কনশাসনেস। তাহলে চেতন কি?
চেতন সবকিছুই। ইটকাঠবালিসিমেন্ট চেতন না হলে বাড়ি যেমন চেতন হয় না; তেমনি মলাট থেকে শুরু করে নিছক একটি শূন্যস্থান পর্যন্ত চেতন না হলে সেই বইয়ের কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। যেখানে প্রোডাকশন নিয়ে আর কোথাও রহস্য নেই, সেখানে অযথা আমি কেন লেখক নামক একটি প্রোডাক্ট হতে যাব! আমার তখন ইচ্ছে হবে প্রডিউসার হওয়ার। সিনেমার ব্যবসায়ী প্রোডিউসার নয়, আমি তাঁর কথা বলতে চাইছি যে জানে অচেতন লেখা তৈরি করে অচেতন মন, একমাত্র সচেতন লেখাই পারে হৃদয়ের সমস্ত অন্ধকার ভেঙে, আকাশের তিমির ঘুচিয়ে ঊষাকে আমন্ত্রণ জানাতে। মার্ক্সিস্ট ক্রিটিসিজম বলে, সংসারে সাম্য নেই তাই মন অশান্ত, ভারতবর্ষ বরং বলবে মনে অশান্তি, তাই তো সংসার! অতএব আমি কীভাবে দেখছি, আমার দৃষ্টিভঙ্গী কি সেটা লেখার থেকে বেশি গুরুত্বপুর্ণ। তাই ভালো লেখা খারাপ লেখা বলে কিছু নেই, লেখা হয় সচেতন নইলে অচেতন। আর আমি পাঠক হিসেবে সেই লেখা পড়ে অনুধাবন করলাম কি, একটু শান্ত হলাম কি!
আমি তাই দেখি, সবচেয়ে সহজ যা, তাকে ব্যাখ্যা করতে ভারতবর্ষ তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল দর্শনের জন্ম দিয়েছে। আমি এইটুকু জানি, এইটুকুই জানাতে চাইছি। সেই অল্পকে অল্পকথায় প্রকাশ করব বাগদেবীর কাছে সেই বর চাই। হোয়াটসঅ্যাপে এতকথা লেখার অবকাশ ছিল না, আলস্যের অজুহাত এড়িয়ে উত্তর এই এত বড় করে দেওয়ার প্রয়োজন সত্যিই কি ছিল? পাঠক বলবেন… আমি শুধু তাঁর প্রথম প্রশ্নের উত্তরটুকুই হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, কত সহজ এই কথা, তাহলে সাধ করে আমার বিপ্রলম্ভ কেন! অভিমান কেন!”
পাঠক বলুন তো শেষটা সহজ হলো কিনা!