যে রাজা হতে চায় না, চায় না নায়কের প্রস্থান; সফলতা বা সংসার সম্বন্ধে যার ধারণা মোটিভেশনাল স্পিকার বা সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে মেলে না, সে কীভাবে খাপ খাওয়াবে এই সময়ে?
“যে রাজা হতে চায় না, চায় না নায়কের প্রস্থান; সফলতা বা সংসার সম্বন্ধে যার ধারণা মোটিভেশনাল স্পিকার বা সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে মেলে না, সে কীভাবে খাপ খাওয়াবে এই সময়ে?”
যুদ্ধ জয়ের পর ম্যাকবেথ যখন রাজার কাছে ফিরছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হয় যে তিনজন পিশাচিনীর, অনেকের মতে সে’ দলেরই আরেকজন নাকি তাঁর নিজের স্ত্রী-ও। সেই তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই বোঝা যায় বাইরের যুদ্ধ জয় করার বীরত্ব ম্যাকবেথের থাকলেও নিজের ভিতরের যুদ্ধে তিনি ততটা মহাবীর নন। সন্ন্যাসী রাজা-র মতন ক্লাইম্যাক্স তাঁর জীবনে তাই কোনোদিন আসেনি।
লেডিকে আমি উচ্চাশা বলেই জেনেছি। উচ্চাশা যখন শেষ হয়ে যায়, ভোগ যখন নিভে আসে, চেতনাই যে অযোনিজ, তিনিই যে কাল, সে একমাত্র তখনই বোঝা যায়। যমকে মৃত্যুর দেবতা হিসেবে পেতে পরিশ্রম করতে হয় ততটুকুই যতটা জলকে নীচের দিকে বইতে। তাকে গুরু হিসেবে চেনা সে ভাগ্য ম্যাকবেথের কপালে কই। আমরাও কি সেই উচ্চাশাতেই ‘তুঝ মে রব দিখতা হ্যায়’ বলে মন সঁপে দিই না?
কথা হচ্ছিল রামের সঙ্গে। কয়েকবছর আগে নামটুকু বললেই বোঝা যেত কোনও পরিচিত পুরুষের কথা বলছি। বর্তমান সোশিও-পলিটিক্যাল প্রেক্ষাপটে এই রামের সঙ্গে যে রামায়ণের কোনও সম্পর্ক নেই তা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সে আমার হোস্টেলে কোরাসে জীবনসঙ্গীত গাওয়ার আরেক গলা। উপাধি রামশঙ্কর। একদম উপরে কোটেশনের ভিতর যে প্রশ্ন বন্ধ, সে জিজ্ঞাসা তাঁরই। দোষের মধ্যে আমি কেবল আমার নতুন বইয়ের খবর দিতে ফোন করেছিলাম। আর প্রসঙ্গ ছিল বন্ধুস্থানীয় কিছু মানুষের সমাজে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাওয়া, বা আগামীদিনে বাংলা প্রবন্ধ অ্যাকাডেমি বা কথা অ্যাকাডেমির চেয়ারপার্সন হিসেবে প্রমোটেড হতে চাওয়ার বাসনা। কেরিয়ারে সাফল্য চাওয়া তো ভুলের কিছু নয়! কিন্তু আমার ব্যক্তিগত খারাপ লাগে তাঁদের জন্য যারা ফাউস্ট-এর মিথ সম্বন্ধে পরিচিত নয়। ফাউস্ট ও ম্যাকবেথের ভূতও যে কখনও বাঙালিকে ভর করবে এ আমার কল্পনাতীত। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও মেনে নিতে যতই দুঃস্বপ্নের মতন লাগুক, তাও তো বাস্তব। শামসুল হকের ‘কথা সামান্যই’ বই-এর ‘ছাপা অক্ষর’ লেখাটার কথা মনে পড়ে গেল-
“ছাপা অক্ষরে মানুষের ছিল কী অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি। এখন সে অক্ষরে আর কেউ বিশ্বাস করে না। ছাপা অক্ষর মানেই এখন আমাদের সন্দেহের স্থল... সত্যের সঙ্গে চালান দিলে, মিথ্যেটাও সত্য বলে পার পায়।”
আপাত এই নিরীহ ওর ওই প্রশ্নের জবাবে আমি চুপই ছিলাম। মূলত সহ্যশক্তির নামে আমার সমস্ত নিরুত্তরকে আমিও ন্যায্য বলে ধরে নিয়েছি। মঞ্চ অথবা কাগজ, কথা বলার যেকোনো অবকাশকে নিছক প্ররোচনা বলে মেনে নিতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু রামের এই প্রশ্ন ঠিক ততটা হিংস্র নয়। তবু চুপ থাকা আমার ঢাল। কথায় কথা বাড়ে; কথাই ইন্সিকিওরিটির জন্ম দেয়। মনে পড়ল হঠাৎ, ওর হাত দেখে প্রথম দিনই হোস্টেলের কেউ ভবিষ্যতবাণী করেছিল, “তুই রাজা হবি”! রামের জবাব ছিল “বাল, ওই লঙ্কাদহন আমার চাই না”।
কিন্তু উত্তর দিতেই হতো। উত্তর দিলামও তাই-
“যার কোনও চাওয়া নেই, সেই পরম লোভী”।
Comments (0)
Rate this Article
How do you feel about this article?
Comments (0)
No comments yet
Be the first to share your thoughts!
Join the Discussion