গোপনবাসীর কান্নাহাসি ৪ : শব্দ - Rik Amrit

গোপনবাসীর কান্নাহাসি ৪ : শব্দ

Listen to this article

Enjoy hands-free reading with our audio player

3 min listen Multiple voices available
Ready to play
Audio Controls
Ready to play

দেশ আকাশের পর্যায়বাচী শব্দ। আকাশের পর্যায়বাচক হৃদয়। এই খেলাগুলি আমার বেশ ভালো লাগে। এভাবেই ‘বই’ এই শব্দটির পাঠ আমাকে মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন করায় বিনা টিকিটে। পশ্চিমবঙ্গে বইয়ের বর্তমান অবস্থায় তাতে একটু অপরাধবোধ যে হয় না, তা নয়। তবে এই খেলায় কোন রক্তপাত নেই, উস্কানি নেই, এমনকি ক্রিকেটের যে ডার্ক ওয়ার্থ লুইস সিস্টেম, তাও নেই। ফলত সে উপদ্রবহীন। রবীন্দ্রনাথের গানে শুনি যে ভ্রমি শব্দটি, আমার কাছে ভুলের ভিতর ভ্রমণের দ্যোতনা নিয়ে আসে। তাতে শব্দটির কাঙ্ক্ষিত অর্থ নিয়ে আমার তত মাথাব্যথা কাজ করে না। একইভাবে কাল, কখনও মৃত্যু, আবার যদি তাই হয়, তাহলে হিমালয় ছেড়ে এসে বেনারসে দেবীর পদার্পণ, যা আসলে কালের সূচনা, তাকে  সৃষ্টি নয়, মহামৃত্যু বলেই ডাকতে ইচ্ছে হয়। রসায়ন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যেমন রসের যাত্রা। যদি রসের পর্যায় হিসেবে সোনা ধরি, তাহলে যে বিষয়টি উঠে আসে, তাতে পাওলোবাবু খুব খুশি হবেন। ভাববেন তাঁর উপন্যাসের প্রচার করছি।

এই বৈরাগ্য সকল মাথায় আসে, চিন্তার ভিতর ঘুরপাক খায়; কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে তারা আকার পায় না। যথেচ্ছে পড়াশোনা আমাকে দিন দিন আরও একা করে। লেখাই তখন হয়ে যায় কাগজের সঙ্গে আমার কথোপকথন।

খুব সহজ করে লিখতে গেলে, শব্দের প্রতি, ভোকাবুলারির প্রতি মানুষের অনীহা নিয়ে আমি সত্যিই চিন্তিত। আপনাকে বাংলা ভাষার শব্দজ্ঞান বাড়াতে হবে, আমি এমনটা বলতে চাইছি না। কিন্তু আপনি যে ভাষায় ভাবেন, সেই ভাষার যথেষ্ট পরিমাণ শব্দ যদি আপনি না জানেন, তাহলে আপনার চিন্তায় দৃশ্যকল্প তৈরি হবে না। আপনার মস্তিষ্ক হবে দুর্বল। প্রোপাগান্ডা বা যেকোনো তর্ক চিনতে বা বুঝতে আপনি ভুল করবেন। আমরা একটা জিনিস সাধারণত উপেক্ষা করি। একটি ভাষা বলতে গেলে, এবং যথেষ্ট ভালো ভাবে বলতে এক হাজার শব্দের বেশি জানার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই একহাজার শব্দের জ্ঞান আপনাকে সেই ভাষায় চিন্তা করার শক্তি জোগাবে না। আপনি নিজের মাতৃভাষায় প্রথমে চিন্তা করবেন তাঁর পর সেই চিন্তাটাকে ওই হাজার শব্দ দিয়ে  অনুবাদের চেষ্টা করবেন। এটাই হবে।

বাংলা ভাষায় এমনিতেই ক্রিয়া পদের অভাব। এই ভাষায় গদ্যসাহিত্য রচনা করা সেই জন্যেই এত কঠিন। এবং শেষ একশ বছরে আপনি বেশি গদ্য লেখক পাননি তাঁর বড় একটা কারন যে এটাও এমনটাই মনে হয়। বাংলায় একশ বছরে ভালো উপন্যাসের সংখ্যা পাঁচশ-এর বেশি হবে না। এটার দ্বিতীয় বড় কারণ বাংলা-র কেবল নিজস্ব শব্দকোষ না থাকাও বটে। বাংলায় কাব্যে উপন্যাসে ফারসি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথও এই কারণেই বিরক্ত ছিলেন। কারণ তা ভাষার শুদ্ধতার কারণে এমনটা নয়। তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা মানুষের চিন্তাশক্তির উপর ফেলে। বাংলাদেশের জাতীয়ভাষা বাংলা হলেও, সেখানে আত্মিক সম্পর্কগুলিকে তাই রাষ্ট্র মাসি-পিসির বদলে খালা-ফুফি ইত্যাদি শব্দও দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। একে চেনা একজন লেখকের দায়িত্ব। এই জন্যেই যে লেখে সেই লেখক নয়। যার লেখা চেতন, যে লেখার সময় দায়িত্ব নিয়ে লেখে তাকেই লেখকের ওই গাউনটি মানায়।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একসময় খুব শিক্ষিত হতেন বলে শুনেছি ও পড়েছি। আজ তার প্রতিফিলন দেখি না, কারণ বাঙালির নিজস্ব ভাষা নেই, তাই? এই সমস্যাটা বাংলাদেশে আরও বেশি। নইলে সেখানেও আমরা কেবল আট নয়জন লেখকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যেতাম না। বাঙালিকে বাংলা ভাষায় কিছু বোঝানো সিসিফাস হয়ে পাহাড়ের উপরে পাথর তোলার চেয়ে কঠিন। লেখার ভিতর বিদেশি শব্দ মিশিয়ে দিয়ে তাকে অলঙ্কার বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমার মধ্যেও তাই কম না। 

Comments (0)

Rate this Article

0.0 (0 ratings)
How do you feel about this article?
Comments (0)
💬

No comments yet

Be the first to share your thoughts!

Join the Discussion
0/1000 characters
Page-Specific Footer Example