ভারতীয় রসবাদ ও বর্তমান বঙ্গরঙ্গচর্চা (পর্ব ১) - Rik Amrit

ভারতীয় রসবাদ ও বর্তমান বঙ্গরঙ্গচর্চা (পর্ব ১)

Listen to this article

Enjoy hands-free reading with our audio player

3 min listen Multiple voices available
Ready to play
Audio Controls
Ready to play

ব্যক্তিগত চর্চার কারণে আমি খেয়াল করে দেখেছি ভাষার ভিতর কিছু শব্দ আছে যারা ভীষণ ইনফরমেটিভ। কেবল একটি শব্দকে বিস্তার করতে গিয়ে আরও একটা গোটা বই লেখা যেতে পারে। যেমন অগ্নি! অগম্যকে গতি দেয় যা। ঠিক এই তথ্যের উপর নির্ভর করেই আমি উপলব্ধি করি বায়ুও এক অর্থে অগ্নি! একটি শব্দ যেমন অহম! শিবের বীজ অ, দেবীর বীজ হ এবং তার ম্যানিফেস্টেশন, বিন্দু পুটিত হলে হয়ে ওঠে অহম। তাই অহম কথাটি বলার পর আরও কোনও কথা বলার প্রয়োজন থাকে না। তেমনই একটি শব্দ আছে ‘নাট্য’! কেবল এই একটি শব্দের বিস্তার হে পাঠক আপনাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভ্রমণ করিয়ে দিতে পারে। নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় পড়ানোর সময় পিয়ালদা আমার নোটবুকে এই শব্দটার বিস্তার করতে গিয়ে পুরো নাট্যশাস্ত্রের ছত্রিশ অধ্যায়ের একটি ক্রম ফ্লো চার্টের মতন করে এঁকেছিলেন। মনে পড়ে! আবার কিছু কিছু শব্দ আছে যার কোনও বিকল্প নেই। যেমন আনন্দ, যেমন শিব, যেমন সত্য। আপনি যেভাবেই লিখুন না কেন, সত্য শব্দটিকে বা সুন্দর শব্দটিকে সরাসরি আর অন্য কোনও শব্দ দিয়ে রিপ্লেস করা সম্ভব নয়! আবার কিছু শব্দ আছে যা আপনাকে কোনোই ইনফরমেশন দেয় না। নাট্যের প্রসঙ্গে আছি তাই, উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে ‘রস’। আপনি সিন্ধুকে রস বলতে পারেন, আপনি পারতপক্ষে সোনাকেও রস বলতে পারেন, কিন্তু রসকে অন্য কোনও শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারবেন না! তত্ত্বগতভাবে রসের সংজ্ঞা দুইটি, রাস্যতে ইতি রসঃ এবং রসনাম রসঃ। কিন্তু এইদুটিই রসের সবিকল্প অবস্থা! রস শব্দটার মধ্যে দিয়ে রসের স্বভাব ধরা পড়ে না। রসের নির্বিকল্প অবস্থায় পৌঁছানো তাই বেশ সাধনার বিষয়! তা ধ্যানের মধ্যেই হয়! তা হয় অনুভবে, ভাবনায়! এই অনুভব নির্ভর করে অধিকারীর ক্ষমতার উপর! যেমন সমাধি পিপীলিকাবৎ হবে না মীনবৎ হবে নির্ভর করে সাধকের সাধনক্ষমের উপর, এও ঠিক তেমনই! রসের এই সাধনা ও চর্চাকেই আমরা নাট্যচর্চা বলে অভিহিত করতে পারি? ভারতবর্ষের যেকোনো শিল্প আসলে কি এই রসেরই সাধনা? নাট্য সাধনা?    

বঙ্গদেশে বর্তমান শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও বিষয়টা কি তাই? একটু বিস্তার করে বলে যাক! বাংলা নাট্যচর্চা কথাটির মোটামুটি দুটি মানে দাঁড়ায়; এক বাংলা ভাষায় নাট্যচর্চা আর বঙ্গদেশে নাট্যচর্চা। প্রাচীন বঙ্গদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জনপদ তাম্রলিপ্ত; শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও তার বিশেষ অবদানের উল্লেখ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যায়। আমি পাঠক হিসেবে এই বঙ্গদেশের সবচেয়ে পুরনো নাট্যাচার্য/কাব্যাচার্য হিসেবে উল্লেখ পেয়েছি রাহুল নামক জনৈক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর। নাট্য তথা কাব্যচর্চায় যে কাশ্মীরের অবদান অনস্বীকার্য, সেই কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের বংশধরের এই বাংলার রাঢ় অঞ্চলে নাট্যশাস্ত্র অনুসৃত অভিনয় দেখার উল্লেখও পাওয়া যায়। পালযুগেও মার্গনাট্যের এই ধারা অবিচ্ছিন্নই ছিল; সেনযুগ আলো করে তো কবি জয়দেব রয়েছেনই। এই আমাদের ঔড্রমাগধী পরম্পরা!

মোটামুটি মুসলিম আক্রমণ পর্যন্ত এইধারার ইতিহাসটি যে অবিচ্ছিন্ন তা পাঠক হিসেবে একটু কৌতূহলী হলেই জানা যায়; যারা রিসার্চ করছেন তাঁদের কাছে এ আর নতুন কি! আমার বিশ্বাস ঠিক এই সময় আকস্মিক পুঁথির অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সাহিত্যে সান্ধ্যভাষার জন্ম দেয়, এবং সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে আজকের বাংলাভাষায় তা রূপান্তরিত হয়। তাই লেখার শুরুতে বঙ্গদেশ বলতে বঙ্গ-বিহার-ওড়িশা-আসামের ঠিক বিশাল অংশটিকে চিহ্নিত করছিলাম, এখন মুসলিম আক্রমণের পর তাকে একটু ছোট করে নিতে হয়। শিল্প চর্চাতেও ভাটা আসে, কিন্তু থেমে যায় এমনটা নয়! বরং নাট্যচর্চার অভ্যেস না থাকলে চৈতন্যদেবের পক্ষে সেই নাট্যচর্চাকে ভগবৎ জ্ঞানের প্রচারে যাত্রার মতন করে ব্যবহার করার ভাবনা সম্ভবপর হত বলে মনে হয় না। এমনকি চৈতন্যদেবের সময়ে নাট্যচর্চা ছিল শুধু তা নয়, বরং নতুন নতুন নাট্যরচনা হয়েছে সে উদাহরণও আছে। নাট্যের এই ইতিহাস ভারতীয় নাট্যের ইতিহাস।  

কিন্তু আমরা একে ইতিহাস বলে মেনে নেবো না। আমরা অর্থাৎ যারা ইয়োরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা হাতিঘোড়াহনু ও হুব্বার দল। আমাদের শিল্পচর্চার ইতিহাস তাই শুরু হয়, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। কারণ তার আগে বাংলা ভাষার সুসংহত রূপ কই! আমাদের তাই অপেক্ষা করতে হয়, সতেরো শ’ ছিয়ানব্বই অব্ধি ব্রিটিশ আনুকূল্যের! নগরের কীর্তন না দেখলে গাঁয়ের মোড়লের নইলে তো মর্যাদা থাকে না। ক্রমে তাই তর্করত্ন মহাশয়, মধুকবি এবং গিরিশ ঘোষ; ব্রিটিশ নাটকের মিমিক্রিকে গাঁয়ের মোড়ল আমাদের কাছে মাইমেসিস বলে উপস্থিত না করলে আমাদের শ্রদ্ধা জন্মাবে কী করে! আমরা আজ যে নাট্যচর্চা দেখতে পাই এই বিভক্ত বাংলায় তা সেই অবিভক্ত বাংলার কলোনিয়াল কালচারেরই এক্সটেন্ডেড মেধাহীন এক রূপ! যারা একটু খোঁজখবর রাখেন তাঁরা একে ইয়োরোপ ও আমেরিকার শিল্পচর্চার ছিবড়ে বললে আপত্তি করবেন না বোধ হয়! নাট্যের এই ইতিহাস আসলে কলকাতার নিজস্ব ‘নাটক’ (অতিব্যাপ্ত দোষে দুষ্ট আহা-উহু এক বাংলা শব্দ)-এর ইতিহাস; রূপকের বা ভারতীয় পার্ফরমিং আর্টসের ইতিহাস নয়।

এখন ললিতকলার অন্যান্য অঙ্গেও এর কোনও ব্যতিক্রম যে দেখি তা কিন্তু না। শেষ দু’শোবছরে এই বাংলায় ঠাকুর পরিবারের চারজন সদস্যকে সরিয়ে রাখলে এই বঙ্গদেশে মনে রাখার মতন ‘কথাঞ্জলি’ ছাড়া আর আছে কি! জেন জি যাকে ওজি বলে, সেই অরিজিনাল শিল্প তৈরি হওয়ার আগেই তাই বাংলায় এসে পড়ে পাশ্চাত্য প্রভাব। ফিউশনের ধারা। সঙ্গীতে বাংলা সিনেমা থেকে রবি রকজ, নাচে সৃজনশীল ডান্স বাংলা ডান্স। বাংলা কাব্যের ইতিহাস বলতে তা কবিতার ইতিহাস, যে কবিতা রচনা করার জন্য নন্দনতত্ত্বের বোধ না থাকলেও চলে। কফি হাউসের টেবিল চাপরে তাঁরা এই কথাই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন! তাই তাঁদের পাঠকদের ‘ধ্বনি’ বললেই আকাশ থেকে পড়তে হয়! ‘রস’ বলতেই তাঁরা হয় বোঝেন খেজুর গুড়, নইলে রতি! আর তাই বাংলা ভাষায় অসংখ্য কবিতা, কিন্তু কাব্যের সংখ্যা কম। ঠিক যেমন ভোটার বেশি, পাঠক কম। এখন পাঠক কম কিন্তু ভোটার বেশি হলে ঠিক কীরকম সমাজ তৈরি হয়, তা আপনি আপনার চারপাশ দেখলেই বুঝতে পারবেন। অবশ্য না বুঝে, বোঝার ভান করলেও প্রাপ্য হাততালি পেতে খুব সমস্যা হবে না।

Comments (0)

Rate this Article

0.0 (0 ratings)
How do you feel about this article?
Comments (0)
💬

No comments yet

Be the first to share your thoughts!

Join the Discussion
0/1000 characters
Page-Specific Footer Example