পৌরাণিক কাহিনি ছাড়াও এই উপপুরাণের মধ্যেই বিশ্বতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, কাল-বিভাজন, প্রতিকূল গ্রহ ও নক্ষত্রের আনুকূল্য লাভের জন্য কৃত্য শান্তিস্বস্তয়নের পদ্ধতি, বংশলতিকা (প্রধানত রাজা ও ঋষিগণের), আদর্শ আচরণবিধি ও রীতিনীতি, শাস্তিবিধান, আইন ও রাজনীতি, যুদ্ধকৌশল, মানুষ ও পশুর রোগচিকিৎসা প্রণালী, খাদ্যবিধি, ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলংকারশাস্ত্র, শব্দার্থ, নাট্যকলা, নৃত্য, কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এবং শিল্পকলা নিয়েও আলোচনা আছে। এই উপপুরাণেরই তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে চিত্রসূত্র। গীতি-নৃত্য-বাদ্যের যেমন নাট্যশাস্ত্র, চিত্রকলার জন্য ঠিক তেমনই এই চিত্রসুত্র। ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব এই অংশটি ছাড়া সম্পুর্ণ হয় না।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে লাইব্রেরিগুলির উপর বা মন্দিরগুলির উপর একের পর এক আক্রমণের ফলেই হোক বা কালের লৌকিক নিয়মে, এই পুরাণে উল্লিখিত পুরনো শাস্ত্রগুলির হদিশ আজও আমাদের নাগালের বাইরে। এই সংকলন অনুবাদে পড়লেও বোঝা যায় ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের প্রাচীনতার কাছে এই উপপুরাণটি নিছক কতটা নবীন, এবং এই পুরাণকে নন্দনতত্ত্বের একমাত্র প্রচেষ্টা হিসেবে ভেবে নিলে ভুলই হবে।
চিত্রসূত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। স্টেলা ক্র্যামরিশ এর অনুবাদ করার সময় নিজের মতন করে মূল বিষয়গুলির উপর তাঁর ব্যাখ্যাও করেছেন। তবে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত আনন্দ কুমারস্বামীর কাজটিই সেই অর্থে প্রথম বিস্তৃত কাজ। যেকোনো ভারতীয় শিল্প পদ্ধতিই আসলে ধ্যানমূলক। সেখানে এক্সপ্রেসিজমের জায়গা খুব অল্পই। তিনিই প্রথম চিত্রসূত্রের পদ্ধতিগুলিকে যোগের সঙ্গে তুলনা করেন। এবং তাঁর ফলে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে আগমের তাৎপর্য আমাদের কাছে প্রথম ধরা দেয়।
তৃতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে সাধারণত চিত্রকলার উৎপত্তির পৌরাণিক ইতিহাস এবং শিল্পগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অধ্যায় ২-১৭ ব্যাকরণ, অভিধান, মাত্রা এবং অলঙ্কার বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করে। অধ্যায় ১৮-১৯ গীত এবং যন্ত্রসংগীত নিয়ে আলোচনা করে। অধ্যায় ২০-৩৪ নৃত্য এবং নাট্যবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করে। অধ্যায় ৩৫-৪৩ এ রয়েছে ভারতীয় চিত্রকলার বিভিন্ন শাখা, পদ্ধতি এবং আদর্শের বিবরণ। অধ্যায় ৪৪-৮৫ প্রতিমালক্ষণা (মূর্তির লক্ষণ) নিয়ে আলোচনা করে। অধ্যায় ৮৬-৯৩ মন্দির তথা স্থাপত্য নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা করে। অধ্যায় ৯৪-১০৮ আবাহন (মূর্তিতে প্রানপ্রতীষ্ঠা) এবং অধ্যায় ১০৯-১১৮ আচার এবং অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে এই খণ্ড শেষ হয়।
সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হল, নৃত্যের সঙ্গে চিত্রের সম্পর্ককে বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ যেভাবে বর্ণনা করে। তৃতীয় খণ্ড, অধ্যায় ৪৩
যদত্র নোক্তং তন্নৃত্তাদ্বিজ্ঞেয়ং বসুধাধিপ ।
নৃত্তেঽপি নোক্তং তচ্চিত্রাত্তত্র যোজ্যং নরাধিপ॥ ৩৭ ॥
এখন এর অন্বয় করলে আমরা পাই
यदत्र नोक्तं: যা এখানে বলা হয়নি
तन्नृत्तात्: তা নৃত্য থেকে
विज्ञेयं: বোঝা উচিত
वसुधाधिप: হে পৃথিবীর অধিপতি
नृत्तेऽपि नोक्तं: নৃত্যতেও যা বলা হয়নি
तच्चित्रात्: তা চিত্রকলার থেকে
तत्र योज्यं: সেখানে প্রয়োগযোগ্য
नराधिप: হে নরকুলের অধিপতি
অর্থাৎ চিত্রের প্রয়োগ তথা দর্শনের এই আলোচনায় যদি কিছু বাকি থেকে যায় তাহলে নৃত্য অধ্যায়ে তা দেখা যেতে পারে, আর নৃত্য অধ্যায়ে যদি কোনো সংশয় থেকে যায়, তাহলে তার জন্য চিত্রসূত্র তো রইলই।
Comments (0)
Rate this Article
How do you feel about this article?
Comments (0)
No comments yet
Be the first to share your thoughts!
Join the Discussion