স্বর্গ থেকে কোনো কিছুই অভিশাপ না পেলে পৃথিবীতে নেমে আসে না; আর সেই অভিশাপও আসলে পূর্বনির্ধারিত, নিয়তির দ্বারা পরিচালিত। পৌরাণিক গল্পের এটাই টেম্পলেট! কেন কে জানে! নাট্যের ক্ষেত্রেও তাই তার অন্যথা হয়নি। এই আখ্যানটিকে আমরা দুটি পর্বে অধ্যয়ন করার চেষ্টা করব।
প্রথম পর্ব – নাট্যশাপ
নাট্যের সফল রঙ্গায়ন তথা নাট্যবেদের জ্ঞানে মদোন্মত্ত হয়ে একসময় আচার্যের সকল পুত্রেরা সর্বলোককে নিজেদের হাস্যরসাত্মক প্রহসনগুলির দ্বারা পরিহাস করতে শুরু করেন। পরিবেশনার মধ্যেও তাই প্রবেশ করতে থাকে দুরাচার তথা নানান গ্রাম্যধর্মীতা। কোনো এক নাট্যপ্রয়োগে তাঁরা একবার প্রসিদ্ধ ঋষিগণের পরিহাস করে বসেন এইভাবে। ঋষিরা অনর্থক এই বিড়ম্বনায় যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হন; অপ্রয়োজনীয় এই অপমানে নাট্যের অভীষ্ট সিদ্ধি সম্বন্ধেও সন্দেহ প্রকাশ করেন।
নটদের এই দুর্বিনীত আচরণ হেতু অতএব তাঁরা দুটি অভিশাপ দেন; প্রথমত যে জ্ঞানে মদোন্মত্ত হওয়ার কারণে এমন আচরণ, নাট্যের সেই ‘কুজ্ঞান’ নষ্ট হয়ে যাবে অচিরেই। দ্বিতীয়ত ঋষি ও ব্রাহ্মণের সভায় তথা নটদের বেদজ্ঞ বলে তো বোধ হবেই না, বরং তা থেকে নীচ এমনকি শুদ্রস্বভাবসম আচরণ হয়ে যাবে তাঁদের। তাঁদের বংশে জন্ম নেওয়া সন্তানেরাও তাই শূদ্র বলেই চিহ্নিত হবে। অন্যের আশ্রিত হয়েই নিজস্ব জীবনকে অতিবাহিত করতে হবে, এই হলো নটের নিয়তি।
যে জ্ঞান ছিল সার্ববর্ণিক, সেই জ্ঞানই মদোন্মত্ত আচরণের কারণে হয়ে গেল কুজ্ঞান! যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ এই ঘটনা! আমার বুদ্ধের সমকালের কথা মনে পড়ে, আমি কল্পনা করি পারি ঠিক কোন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাসদেব সূত ও মাগধদের শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন পুরাণ জ্ঞানে; কেন বেদের সম্পাদকের কর্মকান্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডকে আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হলো! কেন ব্রাহ্মণ্যবাদের সূচনা হয়! তাই এই সব ভীষণ বাস্তবিক বোধ হয়! আপাতত এখানে কোনো টীকাটিপ্পনী না করে, গল্পের পরবর্তীতে বরং একটু মন দিই।
দেবতারা এই অভিশাপের কথা জানতে পারলে তাঁরা ঋষিদের সম্মুখে উপস্থিত হন এবং নাট্যজ্ঞানের নাশ সম্পর্কিত অভিশাপের প্রতি খেদ প্রকাশ করেন। তাঁদের অনুরোধে ঋষিগণ নাট্যের জ্ঞান যে নাশ হবে না, সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা দিলে, অভিশাপের অতিরিক্ত অংশ আর ফেরত নেননি। ভরতের পুত্রেরা এরপর রাগ-ক্ষোভ-দুঃখে নিজেদের নাশ করার সংকল্প নিয়ে আচার্যের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকেই উল্টে দোষারোপ করতে থাকেন, এই বলে যে আচার্যের দোষেই তাঁদের এই অবস্থা, নাট্যপ্রয়োগের কারণেই তাঁদের লোকে শুদ্রসমান বলে জানবে।
না পাঠক, এখানেই অবাক হওয়ার কিছুই নেই; এমন স্বভাবও খুব কি অস্বাভাবিক? যাই হোক প্রত্যুত্তরে ভরত তাঁর শিষ্যদের সান্ত্বনা দিয়ে বৃথা শোক না করার উপদেশ দেন; তিনি আরও বলেন, বিপরীতভাগ্য তথা কালের নিয়মেই এই অভিশাপ তাঁরা পেয়েছেন। তাই নিজেদের নিধন করার প্ররোচনা থেকে মুক্ত করে আগামীর কথা ভাবা উচিত। কারণ ঋষিদের কথা মিথ্যা হওয়ার নয় আবার এই ঘটনায় কারুর দোষ নেই। সর্বশাস্ত্রার্থস্বরূপ এই নাট্যবেদ স্বয়ং ব্রহ্মার দ্বারা সৃষ্ট, এবং অনেক পরিশ্রমের পর তাঁরা তা প্রাপ্ত হয়েছেন তাই আচার্য ভরত নিজ শিষ্যদের উপদেশ দেন তাঁরা যেন অপ্সরাসহ নিজ শিষ্যদেরও নাট্যের যথাতত্ত্ব প্রয়োগপুর্বক শিক্ষা প্রদান করতে থাকেন, যাতে এই বিদ্যা কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়।
দ্বিতীয় পর্ব – নাট্যাবতরণ
এক যে ছিল রাজা, তাঁর নাম ছিল নহুষ। এই পর্বটি আমরা এই ভাবে শুরু করতে পারি। নহুষ নিজের নীতি, বুদ্ধি ও পরাক্রম দ্বারা স্বর্গজয় করেছিলেন। নানান দৈবী সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়ে তিনি সেখানেই রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। একদিন গন্ধর্বদের দ্বারা অভিনীত এক গীতিনাট্যের প্রয়োগ দেখে মুগ্ধ হয়ে বিচার করেন মর্ত্যলোকে যদি এর অভিনয়ের অনুষ্ঠান করা যায়! এই অভীপ্সায় তিনি সমস্ত দেবতাদের প্রতি বিনম্রভাবে নিবেদন করেন যদি কোনো ভাবে এই নাট্যাভিনয় ভূলোকস্থিত তাঁর ভবনে অনুষ্ঠিত করা যায়। বৃহস্পতি সহ অন্যান্য দেবতারা মর্ত্যলোকে মানুষদের মধ্যে অপ্সরাদের বসবাস বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বর্গের অধিপতি, তাই তিনি একবার যদি আচার্য ভরতের নিকট এই প্রস্তাব রাখেন এবং নাট্যগুরু যদি সম্মত হন, তাহলে নহুষের অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নহুষ তাই আচার্য ভরতের কাছে গিয়ে অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে নিজের অভিলাষ জানালেন, “হে দ্বিজোত্তম, দেবতাদের নিকট আমি জানতে পেরেছি, আপনিই পূর্বে সকলকে নাট্যবেদের শিক্ষা দিয়েছেন। আপনার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আজ আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম। অতীতে আমার অগ্রজ পুরুরবার ভবনে উর্বসী ক্রিয়াসহ এই নাট্য উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু উর্বসী চলে যাওয়ার পর আমার সেই অগ্রজ কীর্তিশেষ দশা প্রাপ্ত হন, এবং নাট্য সেখানে আবার বিনষ্ট হয়ে যায়। আমি তাই আবার এক বিশেষ তিথিতে বিভিন্ন যজ্ঞাদি ক্রিয়ার সাথে মঙ্গলময় এক অবসরে নাট্যকে পৃথিবীকে পুনরায় প্রতিষ্টিত করতে চাই। আমার অনুরোধ আপনি যদি আমার ভবনে নাট্য উপস্থাপন করতে সম্মত হন।”
আচার্য এই প্রস্তাবে সম্মত হলে, দেবতা ও নিজ পুত্রদের ডেকে পাঠান এবং পৃথিবীতে নাট্যপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা তথা জগতকল্যাণের কথা উল্লেখ করেন। এই কার্যের ফলে কীভাবে নটেরা শাপ থেকে মুক্ত হবেন এবং আগামী দিনে যে তাঁরা আর ব্রাহ্মণজনের ঘৃণার পাত্র হবেন না, সেই সম্ভাবনার কথাও বলেন। তদুপরি স্বয়ং ব্রহ্মাও একথা বলেছেন, “নাট্যপ্রয়োগের সফলতা আপ্তোপদেশ দ্বারাই সম্ভব হয়।” তাই মানুষের মধ্যে এই জ্ঞান বিতরণ করার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
নহুষের অভিলাষে তাই আচার্য ভরতের পুত্রেরা পৃথিবীতে স্ত্রীজনের সহায়তায় নহুষের ভবনে নাট্য পরিবেশন করেন। তদুপরি সেই পুত্রদের সঙ্গে মানুষী স্ত্রীদের অনুরাগের পরিণামে অনেক সন্তানের জন্ম হয় এবং তাঁরাও পরম্পরাগতভাবে নাট্যাভিনয়চর্চা করতে থাকেন। পৃথিবীতে নাট্যের অবতরণ সফল হলে ব্রহ্মার নির্দেশ মতন আচার্যের শতপুত্রেরা পুনরায় স্বর্গে ফিরে আসেন।
য ইদং শ্রুণুয়ান্ নিত্যং প্রোক্তং চেদং স্বয়ম্ভুবা ।
প্রয়োগং যশ্চ কূর্বীতং প্রেক্ষতে চাবধানবান্।।
যা গতির্বেদবিদুষাং যা গতির্যজ্ঞকারিণাম্ ।
যা গতির্দানশীলানাং তাং গতিং প্রাপ্নুয়ান্নরঃ॥
অর্থ:
স্বয়ম্ভু (প্রজাপতি) দ্বারা প্রোক্ত এই বাণী যে নিত্যদিন শ্রবণ করে, এবং যে সতর্কভাবে এর প্রয়োগ করে বা মনোযোগ সহকারে দেখে তিনি বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের যা গতি, যা গতি যজ্ঞকারীদের, যা গতি দানশীলদের, সেই পরিণাম লাভ করেন।
Comments (0)
Rate this Article
How do you feel about this article?
Comments (0)
No comments yet
Be the first to share your thoughts!
Join the Discussion