নাট্যশাস্ত্র: ইতিহাস, ধারণা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পর্ব ৩) - Rik Amrit

নাট্যশাস্ত্র: ইতিহাস, ধারণা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পর্ব ৩)

Listen to this article

Enjoy hands-free reading with our audio player

3 min listen Multiple voices available
Ready to play
Audio Controls
Ready to play
কোনো গৌরচন্দ্রিকা না করেই আমরা এইবার নাট্যশাস্ত্রের অধ্যায় ও তার বিষয়গুলি বিবেচনা করব। কারণ যতক্ষণ না পর্যন্ত নাট্যের আলোচনায় ঠিক কোন কোন দিক উঠে আসছে আমরা জানব ততক্ষণ পর্যন্ত একজন নট ও নাট্যাচার্যের গুণ ও দক্ষতার ধারণা আমাদের পরিস্কার হবে না। ধন্দ থেকেই যাবে ভরত কে এবং কেন তাঁকে আমরা এত শ্রদ্ধা করি। আর দেবেশ চটোপাধ্যায় রচিত পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর অ্যাকাডেমি প্রকাশিত ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্র: একটি সহজ পাঠ’ – এই ধরণের বইগুলির বালখিল্যতাও ঠাহর করা যাবে না। আসলে নাট্য তো কোনো পণ্য নয়। নাট্যের এই অনুশীলন কোনো বাজারের উপর তো নির্ভর করে না। অর্থনীতি যতই এই সংজ্ঞা দিক যে শিল্প অর্থনীতির উপর নির্ভর না করলেও শিল্পী করে, ভারতীয় শিল্পবোধ তথা নান্দনিকতা যে সেই কথাটিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে রাজি নয়, এবং কেন রাজি নয় সেই ধারণাটিই আমরা পাই নাট্যশাস্ত্র থেকে। নট তো সেখানে কেবল একজন ব্যক্তি নন, নাট্য তো কেবল একটি শিল্প মাত্র নয়। তা একটি চর্যা, শৈল্পিক যোগ।

এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন যে এতদিনে নাট্যশাস্ত্রের বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, এবং সমস্ত সংস্করণই যে এক, তা নয়। কোনো সংস্করণে অধ্যায় সংখ্যা সাঁইত্রিশ আবার কোথাও ছত্রিশ। তবে অভিনবগুপ্তপদাচার্য ছ’হাজার শ্লোক সমন্বিত ছত্রিশটি অধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন, তাই আমরাও ছত্রিশটি অধ্যায়ের নাট্যশাস্ত্রকেই বিবেচনা করব এখানে। সেই ছত্রিশটি অধ্যায় হল এইরকম

প্রথম অধ্যায় – নাট্যোৎপত্তি
দ্বিতীয় অধ্যায় –  প্রেক্ষাগৃহলক্ষণ
তৃতীয় অধ্যায় –রঙ্গদৈবতপূজনবিধি
চতুর্থ অধ্যায় – তান্ডবলক্ষণ
পঞ্চম অধ্যায় –পূর্বরঙ্গবিধান
ষষ্ঠ অধ্যায় –  রসাধ্যায়
সপ্তম অধ্যায় – ভাবাধ্যায়
অষ্টম অধ্যায় – উপাঙ্গবিধান
নবম অধ্যায় – হস্তাভিনয়
দশম অধ্যায় –  শারীরাভিনয়
একাদশ অধ্যায় – চারীবিধান
দ্বাদশ অধ্যায় – মণ্ডলপ্রচার
ত্রয়োদশ অধ্যায় – গতিপ্রচার
চতুর্দশ অধ্যায় –  কক্ষপরিধি তথা লোকধর্মী-নিরূপণ
পঞ্চদশ অধ্যায় – বাচিকাভিনয় তথা ছন্দশাস্ত্র
ষোড়শ অধ্যায় – ছন্দোবিচিতি তথা ছন্দ নিরূপণ
সপ্তদশ অধ্যায় – কাব্যলক্ষণালঙ্কারাদি
অষ্টাদশ অধ্যায় –  ভাষাবিধান
ঊনবিংশ অধ্যায় – সম্বোধন তথা কাকুস্বরব্যঞ্জনবিধান
বিংশ অধ্যায় – দশরূপক নিরূপণ
একবিংশ অধ্যায় – সন্ধি নিরূপণ
দ্ববিংশ অধ্যায় –  বৃত্তি বিধান
ত্রয়োবিংশ অধ্যায় – আহার্য অভিনয়
চতুর্বিংশ অধ্যায় – সামান্য অভিনয়
পঞ্চবিংশ অধ্যায় – বৈশিকোপচার
ষড়বিংশ অধ্যায় – চিত্রাভিনয়
সপ্তবিংশ অধ্যায় – নাট্যসিদ্ধিনিরূপণ
অষ্টাবিংশ অধ্যায় – আতোদ্যবিধান
ঊনত্রিংশ অধ্যায় – ততাতোদ্যবিধান
ত্রিংশ অধ্যায় –  সুষির-আতোদ্যবিধান
একত্রিংশ অধ্যায় – তালবিধান
দ্বাত্রিংশ অধ্যায় – ধ্রুবাবিধান
ত্রয়োত্রিংশ অধ্যায় – অবনব্ধাতোদ্যবিধান
চতুর্ত্রিংশ অধ্যায় – প্রকৃতিবিচারাধ্যায়
পঞ্চত্রিংশ অধ্যায় – ভূমিকা
ষটত্রিংশ অধ্যায় – নাট্যাবতরণ অধ্যায়

নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে নাট্যোত্পত্তির বর্ণনা সহ নাট্যের স্বরূপ এবং গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে নাট্যমণ্ডপের নির্মাণ পদ্ধতি এবং নেপথ্যগৃহ, রঙ্গপীঠ, মত্তবারণী, স্তম্ভ-বিধান, দাসকর্ম ইত্যাদির। তৃতীয় অধ্যায়ে নাট্যমণ্ডপের রক্ষার জন্য বহু দেবতার পূজা পদ্ধতি এবং বর-প্রাপ্তির বর্ণনা আছে। চতুর্থ অধ্যায়ে তণ্ডু কর্তৃক প্রযুক্ত তাণ্ডব নৃত্যের বর্ণনা সহ করণ, অঙ্গহার এবং রেচকের বিস্তারিত নিরূপণ করা হয়েছে। এই অধ্যায়েই আমরা পাই তাণ্ডবের উৎপত্তি ও স্বরূপ এবং নৃত্ত ও নৃত্য-প্রয়োগবিধান সহ গীত ও বাদ্যের প্রয়োগ-পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা। নৃত্তশাস্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে এই অধ্যায়ের গুরুত্ব বেশি। পঞ্চম অধ্যায়ে আছে পূর্বরঙ্গ-বিধান। একই সঙ্গে নান্দী, প্রস্তাবনা, ধ্রুবা এবং চিত্রপূর্বরঙ্গ বিধির বিধিবদ্ধ আলোচনাও করা হয়েছে। নাট্য-রচনা ও প্রয়োগের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ।

ষষ্ঠ অধ্যায়েই আছে রসের শাস্ত্রীয় আলোচনা। ঋষিদের করা পাঁচটি প্রশ্ন, রসের নামকরণের ভিত্তি, সংগ্রহ, কারিকা ও নিরুক্তের স্বরূপ, নাট্যসংগ্রহ, রসনিষ্পত্তি, রসের সংখ্যা এবং স্থায়ী ভাবের বিস্তারিত আলোচনা আছে। সপ্তম অধ্যায় ভাবের শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুই অধ্যায় অবশ্য পাঠ্য।

অষ্টম অধ্যায়ে অভিনয়ের চার ভেদ বলার পরে আঙ্গিক অভিনয়ের অন্তর্গত শির, নেত্র, ভ্রূ, কপোল, ওষ্ঠ, মুখ, নাসিকা, গ্রীবা প্রভৃতি উপাঙ্গের অভিনয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে হস্তাভিনয়ের অন্তর্গত সংযুক্ত এবং অসংযুক্ত হস্তসহ নৃত্তহস্তের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। দশম অধ্যায়ে বক্ষ, পার্শ্ব, কটি, ঊরু, জঙ্ঘা এবং পায়ের সাহায্যে করা অভিনয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একাদশ অধ্যায়ে চারী-নিরূপণের অন্তর্গত আকাশচারী এবং ভৌমচারীর বর্ণনা সহ স্থানকের আলোচনা করা হয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে চারীর সংযোগে তৈরি হওয়া মণ্ডলের লক্ষণ, ভেদ এবং প্রয়োগ ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে রয়েছে গতি-প্রচার। এতে চরিত্রদের বিভিন্ন প্রকারের গতিবিধির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

চতুর্দশ অধ্যায়ে প্রবৃত্তি ব্যঞ্জনের প্রতিপাদন সহ লোকধর্মী ও নাট্যধর্মী দুই নাট্যবিধার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। পনেরো থেকে উনিশ অধ্যায় পর্যন্ত বাচিক অভিনয়ের সকল দিক নিয়ে সম্পূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে প্রথম দুটি অধ্যায়ে বাচিক অভিনয়ের উপযোগী ব্যাকরণের বিষয়সহ ছন্দ ও এর ভেদগুলির বিধিবদ্ধ আলোচনা করা হয়েছে। সতেরোতম অধ্যায়ে রয়েছে কাব্য-লক্ষণ, অলঙ্কার, দোষ এবং গুণের বিস্তারিত আলোচনা। আঠারো অধ্যায়ে চার প্রকারের ভাষা ও সাত প্রকারের বিভাষার বিধিবদ্ধ বর্ণনা রয়েছে। উনিশ অধ্যায়ে কাকূ, স্বর এবং এর প্রকারভেদ এবং পাঠ্যের গুণ-দোষাদির সূক্ষ্ম আলোচনা করা হয়েছে।

কুড়ি নম্বর অধ্যায়ে দশ রূপকের বিস্তারিত আলোচনা সহ দশ লাস্যাঙ্গের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। একুশ অধ্যায়ে ইতিবৃত্ত-বিধান, সন্ধি, পাঁচ অবস্থা, অর্থপ্রকৃতি ও অর্থোপক্ষেপকের সাঙ্গোপাঙ্গ বর্ণনা করা হয়েছে। বাইশ অধ্যায়ে আহার্যাভিনয়ের অন্তর্গত নেপথ্য-বিধান, নেপথ্যের ভেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চব্বিশ নম্বরে অধ্যায়ে আছে সামান্যাভিনয়। এতে সাত্ত্বিক অভিনয়ের অন্তর্গত নারীদের স্বভাবজ এবং অযত্নজ অলঙ্কার, হাব, ভাব, হেলা প্রভৃতি অঙ্গজ অলঙ্কার, রস এবং ভাবের অনুসারে শরীরাভিনয়, কামের দশ অবস্থা, দূতীপ্রেষণ এবং নায়িকা-ভেদের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। পঁচিশ নম্বর অধ্যায়ে বৈশিক পুরুষদের গুণ, তার বন্ধু ও দূতী প্রভৃতি নারীদের চেষ্টা তথা নারীর যৌবনের চারটি ধাপের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

অধ্যায় ছাব্বিশ চিত্রাভিনয় সম্বন্ধে বিধিবদ্ধ আলোচনা করে। শারীরাভিনয় অধ্যায়ে যা কিছু এর আগে বাদ পড়ে গিয়েছে, তার সব কিছুর বিস্তারিত আলোচনা এতে করা হয়েছে। সাতাশতম অধ্যায়ে দৈবী ও মানুষী সিদ্ধির বর্ণনা সহ নাট্যের নির্ণায়ক ও পরীক্ষক, দর্শকদের গুণ ও যোগ্যতা ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

আঠাশ থেকে চৌত্রিশ এই ছয়টি অধ্যায়ে সঙ্গীতশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলির প্রতিপাদন করা হয়েছে। আটাশ অধ্যায়ে চার প্রকারের বাদ্য, সাতটি স্বর এবং তার চারটি প্রকার, গ্রাম, মূর্চ্ছনা, শ্রুতি ও জাতির বিস্তারিত বিবেচনা আছে। ঊনত্রিশ অধ্যায়ে সঙ্গীতের জাতিগুলির রসাশ্রিত প্রয়োগ, চার প্রকারের বর্ণ এবং তাদের উপর নির্ভরশীল তেত্রিশ অলঙ্কার, বীণাবাদনের ভেদ এবং বহির্গীতের প্রকারের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। ত্রিশ অধ্যায়ে সুষির বাদ্যগুলির তথা বাঁশিজাতীয় যন্ত্রের বিধিবদ্ধ আলোচনা আছে। একত্রিশ অধ্যায়ে তাল ও লয়ের বিবেচনা সহ আসারিত, বর্ধমান প্রভৃতি গীত-বিধির বিস্তারিত বিবেচনা; বত্রিশতম অধ্যায়ে ধ্রুবাগুলির সাঙ্গোপাঙ্গ বর্ণনা; তেত্রিশতম অধ্যায়ে গায়ক ও বাদকদের গুণ, দোষ এবং যোগ্যতা এবং চৌত্রিশতম অধ্যায়ে মৃদঙ্গ এবং অন্যান্য অবনদ্ধ বাদ্যগুলি এবং তাদের ভেদ, বিধি এবং বাদ্যদেবতাদের নিয়ে বিধিবদ্ধ নিরূপণ করা হয়েছে।

পঁয়ত্রিশ নম্বর অধ্যায়ে রয়েছে পুরুষ ও নারীদের তিন প্রকৃতি, চার প্রকারের নায়ক এবং অন্তঃপুরের পরিজনদের বর্ণনা  ও পাত্রপাত্রীদের ভূমিকার বিস্তারিত আলোচনা। শেষতম অধ্যায় ছত্রিশে নাট্য কিভাবে পৃথিবীতে এলো বা নাট্যের পৃথিবীতে অবতরণ কীভাবে হলো, রয়েছে তার আখ্যান।

– মানে? এতক্ষণ নাট্য পৃথিবীতে ছিল না? তাহলে কোথায় ছিল?

– তিষ্ঠ বৎস্য তিষ্ঠ। সেই উত্তরও পাওয়া যাবে। তবে তার জন্য এখনও সময় আছে।

তবে এই সূচি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। নাট্যকলা ঠিক ততটা সহজ নয়, যতটা আমরা মনে করি। এমন কি শুধুমাত্র নটের জন্য তা নয়, যিনি সামাজিক অর্থাৎ নাট্যের দর্শক তাঁকেও বিশেষ তৈয়ারি করতে হয় নাট্যরসের আস্বাদ পেতে। এই বিষয় প্রতিপাদন কেবল অভিনয়ের বিভিন্ন স্তরকে প্রতিপাদন করে থাকে তা নয়, এগুলির মাধ্যমে নাট্যশাস্ত্রের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের বিস্তার ও গভীরতাও উপলব্ধি করা যায়। এর মধ্যে যে কীভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মানসিক ইত্যাদি নানাবিধ দিক লুকিয়ে রয়েছে তা খুঁজে-বুঝে দেখার পর অনুধাবন করা যায়, নাট্যের মধ্য দিয়ে আনন্দপ্রদান ঠিক কতটা দায়িত্বশীল বিষয়। ভরতের নাট্য তাই কোনো পণ্য নয়। আর তাই নাট্যশাস্ত্র নিঃসন্দেহে ভারতীয় নাট্য তথা শিল্পকলা ও সাহিত্যের একটি অপরিহার্য স্তম্ভ, যা শিল্পী ও গবেষকদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ স্বরূপ। হে আগামীর অভিনেতা, আপনি যদি ভরত হয়ে উঠতে চান, তাহলে এই আপনার ট্রেনিং-এর বিশেষ চেকলিস্ট।

Comments (1)

Rate this Article

0.0 (0 ratings)
How do you feel about this article?
Comments (1)
S

Soumya Chatterjee

Jun 3, 2024 at 8:39 AM

Superb Sir 🙏

Join the Discussion
0/1000 characters
Page-Specific Footer Example