নাট্যোৎপত্তির এই পর্বটি লিখতে লিখতে মহাভারতে অর্থশাস্ত্রের উৎপত্তির গল্পটি বেশ মনে পড়ে। শান্তি পর্বে যুধিষ্ঠিরের রাজা ও রাজ্যপরিচালনা সম্বন্ধিত কৌতূহল মেটানোর জন্য ভীষ্ম অর্থশাস্ত্রের উৎপত্তির কাহিনী বর্ণনা করেন। কেমন ভাবে রাজা পৃথিবী রক্ষা করেন? কেনই বা মানুষ তাঁর অনুগ্রহ চায়? সেও এমনই সত্য তথা কৃত ও ত্রেতাযুগের সন্ধিক্ষণের কথা, জম্বুদ্বীপ যখন প্রশাসনহীন। ত্রেতাযুগের শুরুতে মানুষের মনে গ্রাম্যধর্মের প্রভুত্ব দেখা যায়। এই গ্রাম্যধর্ম অর্থাৎ আমরা আগেই জেনেছি সুখ-দুঃখ-ভোগ-ঈর্ষা-শান্তি-অশান্তি-কামনা-বাসনা ইত্যাদির বোধ। ফলে সমাজ হয়ে পড়ে দিশাহীন। ইন্দ্রাদিদেবতাদের অনুরোধে লোকপিতামহ ব্রহ্মদেব তাই বেদাদি থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে রচনা করেন অর্থশাস্ত্র। এক লক্ষ অধ্যায়ের এই অর্থশাস্ত্রই ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ তথা পুরুষার্থের কথা বলে। বলে সাম দান দণ্ড ভেদ উপেক্ষা আদি আরও পাঁচটি উপায়ের কথা। এছাড়া তর্কবিদ্যা, কৃষিবাণিজ্যাদি বৃত্তিসমূহ, বিচার, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় এই অর্থশাস্ত্রে। ঠিক একইভাবে বাস্তুশাস্ত্রের রচনা করে সেই জ্ঞান বিশ্বকর্মাকে শেখান প্রজাপতি। কামশাস্ত্র? এর এই রকম কোনো উল্লেখ পেলে কমেন্ট বক্স খোলা রইল, জানাতে দ্বিধা করবেন না।
ঠিক এই তুলনামূলক পাঠই সময় ও সভ্যতা নিয়ে আমাদের আরেকটু বেশি কৌতূহলী করে তোলে। জানতে ইচ্ছে করে কী সেই কারণ যা শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তাকে এমনভাবে ট্রিগার করে।
খুব হাল্কা অর্থে যদি স্কুলের ইতিহাসের জ্ঞানটিকেও একটু ঝালিয়ে নিই, তাহলে মনে হয়, এটা সেই সময় যখন মানুষের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমে আসছে, এবং মানুষ ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে জমির মালিক। তাঁর নামের পাশে এসে জুড়ছে সম্পত্তি। সমাজে সম্পদ ও তাঁর অধিকার এই বোধ জন্ম দিচ্ছে পুঁজির। তাই স্বেচ্ছাচার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা এই দুইয়ের অন্তর সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে এই শাস্ত্রগুলি। অনুমান করা যায় স্থায়ী বাসস্থানের ধারণা সত্যযুগে ছিল না। স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণের প্রয়োজন জন্ম দেয় বাস্তুশাস্ত্রের। স্থায়ী সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা। কর্তব্য ও দায়িত্বেরই বোধই কি ক্রীড়নীয়কম্-এর ইচ্ছাকে তথা নাট্যের প্রয়োজনকে কারণ দেয়? কে জানে!
নাট্যের উৎপত্তির সঙ্গে যুদ্ধ বা বিবাদের যে একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে, একথা নাটোৎপত্তির এই গল্প থেকে পরিস্কার হয়ে যায়। প্রথম রূপকে দেব-দানবের যুদ্ধ, প্রথম নাট্যও পরিবেশনাতেও তাই। রণরঙ্গ থেকে রসরঙ্গের দিকে এই যাত্রা খুব মসৃণ নয়। মাঝে মধ্যে তো এমন মনে হয় যে যুদ্ধে ও নাট্যে বোধ হয় আসলেই কোনো ভেদ নেই। এই যেমন ধরুন নাট্যের বীজ বলে ধরা হয় বৃত্তিকে। চতুর্বিধ বৃত্তি যথা, কৈশিকী, ভারতী, আড়ভটি এবং সাত্ত্বতি আসলে তো মধু এবং কৈটবের সঙ্গে শ্রীবিষ্ণুর যুদ্ধেরই পরিণাম। যুদ্ধেরই নানান পরিভাষা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হস্ত-চারী-করণ-মণ্ডল জুড়ে। একজন শিল্পীও কি তাহলে একজন যোদ্ধা? ক্ষত্রিয়? কৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে উপদেশ দেন রণরঙ্গে অনাসক্ত তথা নিষ্কাম হয়ে নিজের দায়িত্ব পালনের, তাহলেই পাওয়া যাবে পরম শান্তি; আমার কেন জানি না মনে হয়, এই অনাসক্তি আসলে রণরঙ্গকে পাল্টে ফেলে রসরঙ্গে; আচ্ছা এই অনাসক্তিই কি ব্রহ্মা উপদেশ করলেন অসুরদের, যারা বিঘ্নরচনা করছিলেন প্রথম নাট্য পরিবেশনার সময়? দর্শক হিসেবে এই অনাসক্তিই কি তবে ব্রহ্মানন্দ আস্বাদ করার সুযোগ করে দেয় তাৎক্ষণিক? একজন শূদ্রকেও দেয় ব্রাহ্মণের অনুভব? কী মনে হয়?
খুব ইচ্ছা হয় এই আলোচনার ব্যাপ্তিতে বয়ে যাওয়ার। ব্লগে লেখার ধৈর্য কমে আসে। কাগজের ক্লাসিক ব্যবহারের কাছে, ব্লগের স্মার্টনেস ক্লান্তিকর মনে হয়। কিংবা হয়তো ততটা উত্তরাধুনিক হয়ে ওঠা গেল না! বাংলা ভাষায় এমন একটা বইয়ের প্রয়োজন অনুভব করি বটে; কিন্তু নিজস্ব গড়িমসির কাছে ঠিক সেরে উঠছি না। পরের পর্বে তবু আলোচনা করা যাবে কীভাবে নাট্যের সূচনা হলো পৃথিবীতে। আজ এই পর্যন্তই…
Comments (0)
Rate this Article
How do you feel about this article?
Comments (0)
No comments yet
Be the first to share your thoughts!
Join the Discussion