কৌরব আজ ওর নামের মানে কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। বুঝতে পারে ‘কৌরব’ এক নয় বহুবচন; সে নিজেই একটা দল, এক অন্ধ আবেগের সন্তান। সে অবাধ্য। যে অভিভাবনে মানুষ স্বচ্ছল হয়, তাকে ফেলে, যা ভীম, তার দিকে ছুটে চলে সে। সেই সে যে ঔদ্ধত্যে মুঠোর মধ্যে বন্দী করতে চাইবে ঈশ্বর, আর তিনি তাকে পরাস্ত করবেন, ডেস্টিনি দিয়ে। কৌরবের ডেস্টিনি কী? পরাস্ত হওয়া! নাহ্, পরাজয় অনিবার্য জেনেও, বিন্দুমাত্র ফাঁকি না দিয়ে যুদ্ধ করা।
সেদিনের পর দু’ বছর কেটে গিয়েছে। নিজের কাজে বিন্দুমাত্র ফাঁকি সে একটুও দেয়নি। গ্র্যাজুয়েশনশেষে প্রাথমিক কাজ ছিল মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া, অভিভাবকেরা এটাই চান। কিন্তু সে ভেবেছে ডিপ্লোমা এনএসডি-র। কিন্তু তখনও সে বোঝেনি সংগঠন, যে জাঁতাকলে পড়ে, বিস্ময় যখন দল ছেড়ে দেয়, তখন রণিদার ভূমিকা নিয়ে ওর অনেক কিছু বলার থাকলেও পারেনি। বিস্ময় ওর ব্যাটনটা কৌরবকে খুব সফলভাবে বুঝিয়েই চলে যায়। যাওয়ার সময় এটাও বলে যায়, “নিজেকে অপরাধী ভাববি না এই নিয়ে। গ্রুপে এরকম হয়।” বাইরে থেকে চোখ ফেরায় সে। নিজেকে একটু কর্পোরেট ভাবতে পারলে হয়তো তার একটু সুবিধেই হতো, এমনটা আজ মনে হয়। কিন্তু কৌরব নিজস্ব উড়োজাহাজের পিছনে একটা ঘুড়ি বেঁধে উড়তে চেয়েছিল। হাওয়ার টানে ঘুড়ি ছিঁড়ে গেছে। একসময় পর্ণাদি-র কাছে সে সবকিছু খুলে বলতে পারতো। নিজের মনে হওয়া সব কিছু। পর্ণাও ওকে তো নিজের ছেলের মতোই দেখতেন। কিন্তু রণিদার সঙ্গে ডিভোর্সের পর, কৌরব নিরপেক্ষ থাকতে পারে না, ফলে সেই আশ্রয়টুকুও হারায়। এই দেড় বছরে সে দেখেছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ কীভাবে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চায়। সে দেখেছে নাট্য অ্যাকাডেমি। সে দেখেছে গণনাট্যের বিপ্রতীপে নতুন সংগঠন নাট্য-আপন। সদ্য নির্বাচিত সরকারের হরির লুট, তার মিটিং। অনুদানের নামে ক্লাব ও থিয়েটার দলগুলোর উদ্দেশ্যে বাতাসা ছুঁড়ে দেওয়া। গ্রান্টের জন্য মারামারি। পৃষ্ঠপোষণা। তেল-ঝাল-মশলা। আর দেখেছে রাজনীতি। লাল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে ক্রমশ গেরুয়া হতে চাওয়া এক অদ্ভুত বসন্তোৎসব। এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই কৌরবদের বাস টার্ণ নিচ্ছে রাস্তা। ঘৃণার কোলাহলে ভরে গেছে চারিদিক। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে মোড়ের মাথায়। পোড়া শবের গন্ধ আসছে ভেসে। সে দেখে একটা ত্রিশূলে গাঁথা ভ্রুণ আকাশশীর্ষে পতাকার মতন উড়ছে হাওয়ায়। কৌরবের শীত করে। সে জানলাটা চেপে বন্ধ করতে চায়। ওর ফোনটা বেজে ওঠে।
আজ থেকে ঠিক আরোও ষোলো দিন পরে কৌরব যখন দিল্লীতে, বঙ্গভবনে বসে লাঞ্চ করছে, তখন প্রেস কনফারেন্সে লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছে রাজ্যের তৎকালীন শাসক দল। একটি বিশেষ খবরের চ্যানেল, যা নিজে এগিয়ে থাকার দরুণ সকলকেও নাকি এগিয়ে রাখে, সেখানেই দেখল, উত্তরবঙ্গের একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সৈনিক হিসেবে সাংসদ পদপ্রার্থী অপর্ণা ঘোষের নাম। অবশ্য এই খবরটা-ই সে রণিদার কাছ থেকে আজ রাত্তিরে বাসে করে মাইশোর যাওয়ার সময় পেয়েছে।
লাঞ্চে আরও যারা যারা ছিলেন সেদিন, তাদের মধ্যে দুজন পরে শাসক দলের হয়ে রাজনীতি করেছেন খাতায় কলমে সে কথা অস্বীকার করলেও, যখন সুব্রত বোস, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী, নাট্য অ্যাকাডেমির সদস্যা অপর্ণা ঘোষের প্রচারে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, সকলেই রাজি হয়েছিল। ততক্ষণে দক্ষিণবঙ্গের আরেকটি কেন্দ্রে সেইসময়ের বাংলা সিনেমার আরেক সুপারস্টারকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করায় বিষম খেয়েছিলেন রণিদা। শোনা গেছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ততদিনে তাঁর ডানহাতের মনোমালিন্য শুরু হয়ে গেছে, আর তাঁকে বার্তা দিতেই এই সিদ্ধান্ত। কেরিয়ারের চূড়োয় থেকে রাজনীতিতে আসতে সেই সুপারস্টার নাকি একদমই রাজি ছিলেন না কিন্তু নিজের ইতস্ততকে না বলতে পারেননি। সে যাই হোক, সেদিনের লাঞ্চে উপস্থিত প্রত্যেকেরই ইগোতে লেগেছিল এই ছেলের প্রার্থী হওয়ার ঘটনা, যেমনটা লেগেছিল এদিনের থেকে সাতবছর আগে, জমি আন্দোলন নিয়ে তৎকালীন বিরোধীনেত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে। রণিদা ও কৌরব দিল্লীতে এসেছিল ‘মেটা’ দেখতে। বাকি চারজনের এই দলের দিল্লী আসার উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গের এক নতুন থিয়েটার ইউনিয়নের দিল্লীতে শাখা তৈরী। রণিদা এই ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট। যদিও তিনি এ বিষয়ে একদম অবগত ছিলেন না।
ফোনটা রেখে দেওয়ার পর সবার আগে কৌরবের মনে পড়ে ওর প্রথম স্টেজে অভিনয়ের পরে এই অপর্ণা ঘোষের গাড়ি করেই দলে ফেরার কথাটা। গাড়িতে ‘গভার্ণ্মেন্ট অফ ওয়েস্টবেঙ্গল’ লেখা লাল স্টিকারে। সেদিন অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে অপর্ণা ঘোষ অনেক কথা বলেছিলেন কৌরবকে। পরে তাঁর কাছে বাচিকাভিনয় শিখতেও যেত সে। কিন্তু আজকের এই ফোনটার পর থেকেই সকল সম্পর্কগুলো একটু একটু করে দূরের মনে হতে থাকে ওর। দিল্লীর বিষয়টা জানার পর রণিদা-ও ওদের থেকে একটু করে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। যা বুঝতে পেরে, একসময়ের খুব কাছের বন্ধু সুব্রত বোসও রণিদা-কে সমস্ত কমিটি থেকে সরে যেতে বাধ্য করলে একটা হুলুস্থুলু কাণ্ড হয়। প্রেস-মিডিয়ায় খবরও হয়। ট্রিপের ম্যানেজার ও পুরনো অভিনেতা সিদ্ধার্থদার কাছে কৌরব শুনেছিল, পার্টির সুপ্রিমো একদিন দুই প্রাক্তন বন্ধুকে মুখোমুখি বসিয়ে সমস্ত সমস্যা মিটিয়ে নিতে বলেন। রণিদা-কে আগামী বিধানসভায় প্রার্থী করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। পরবর্তী বিধানসভা ভোটের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার দিন এখনও আসেনি। কিন্তু সিদ্ধার্থদার কাছে সেকথা শোনার পর কৌরব নিজে যখন রণিদার কাছে এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে চায়, রণিদা তখন ওকে এটাই বলেন যে, ‘আমি সেইদিন প্রার্থী হব যখন রাহুলদা মুখ্যমন্ত্রী হবে’, এই বলে তিনি সোচ্চারে হাসতে থাকেন।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.