নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের কথা তো বলেইছি। এবার দ্বিতীয় আলাপটি হয় আমার রবীন্দ্রনাথের রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন “ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চর বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না।” তখন না হলেও এখন বেশ খানিকটা আন্দাজ করতে পারি, যে রবীন্দ্রনাথ পুরো নাট্যশাস্ত্রটিই অধ্যয়ন করেছিলেন। নইলে এত নিশ্চিন্ত হয়ে এই কথা বলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যেখানে ডঃ এইচ.এইচ. উইলসন ১৮২৬-২৭ সালে তার একটি সংকলনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ‘নাট্যশাস্ত্র, যার উদ্ধৃতি বিভিন্ন পুঁথি ও টীকায় পাওয়া যায়, তা চিরতরে হারিয়ে গেছে’, তাহলে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ও কখন তা পড়লেন!
এই বিষয়ে আমার ফেলুদা হওয়ার সাধ দুটো কারণে জাগে। প্রথমত রহস্যের রোমাঞ্চ আর দ্বিতীয়ত এই ধরনের যেকোনো পাঠের ক্ষেত্রে সংকলনগুলির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে। কোন পাবলিকেশন পড়া উচিত, আর কোনটি নয়, এটি না জানলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয়, এবং ভুল বোঝার সম্ভাবনা থাকে। তাই নিষ্প্রাণ তথ্যের প্রতি চূড়ান্ত অনীহা থাকা সত্ত্বেও আজকের এই আলোচনাটিতে আমাদের অংশগ্রহণ করতেই হচ্ছে। কে জানে এর ফলে রবীন্দ্রনাথের নাটকের উপর যদি নাট্যশাস্ত্রের কোনো প্রভাব আমরা আবিষ্কার করে ফেলতে পারি! বাংলা নাট্যজগতের ইতিহাসে তাঁর মতন মৌলিক দর্শন তো আর কোনো দার্শনিকের মধ্যে দেখি না।
উইলসনের সেই হতাশাজনক ঘোষণার প্রায় চল্লিশ বছর পরে, ১৮৬৫ সালে এফ. হল দশরূপকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে একটি ত্রুটিপূর্ণ পান্ডুলিপি খুঁজে পান এবং সেই পান্ডুলিপির ভিত্তিতে নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাদশ, উনবিংশ, বিংশ এবং চব্বিশতম অধ্যায় দশরূপকের পরিশিষ্ট হিসেবে প্রকাশ করেন। এই প্রথম নাট্যশাস্ত্রের চারটি অধ্যায়ের প্রকাশ। এরপর জার্মান পণ্ডিত হেমান আরেকটি পান্ডুলিপি খুঁজে পান। তিনিই তখনও পর্যন্ত পাওয়া যতগুলি পাণ্ডুলিপি ছিল তার ভিত্তিতে ১৮৭৪ সালে নাট্যশাস্ত্র নিয়ে একটি পরিচিতিমূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
এরপর ফরাসি পণ্ডিত রেনো ১৮৮০ সালে নাট্যশাস্ত্রের সপ্তদশ অধ্যায়, ১৮৮৪ সালে পঞ্চদশ ও ষোড়শ অধ্যায় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায় ফরাসি অনুবাদসহ প্রকাশ করেন। এরপর রেনোর ছাত্র গ্রোসে ১৮৮৮ সালে সঙ্গীত সম্পর্কিত আটাশতম অধ্যায় প্রকাশ করেন। তারপর ১৮৯৮ সালে নাট্যশাস্ত্রের ১ থেকে ১৪ অধ্যায় প্রকাশ করেন। এভাবে রেনো ও গ্রোসে নাট্যশাস্ত্রের এক থেকে সতেরো অধ্যায় এবং আটাশতম অধ্যায়ের ক্রমবদ্ধ প্রকাশ করেন। এই দু’জনের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সময় ফ্রান্সের সংস্কৃত পণ্ডিত সিলভা লেভি ১৮৯০ সালে ‘ইন্ডিয়ান থিয়েটার’ বইতে নাট্যশাস্ত্র নিয়ে একটি ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা সতেরো, কুড়ি এবং চব্বিশতম অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এভাবে পাশ্চাত্য বিদ্বানদের মাধ্যমেই নাট্যশাস্ত্র পুনরুদ্ধার করার কাজ চলতে থাকে।
এই ওয়ার্ল্ড ট্যুর শেষ হলে নাট্যশাস্ত্রের প্রথম ভারতীয় সংস্করণ ১৮৯৪ সালে কাব্যামালা সিরিজের অন্তর্গত করে নির্ণয়সাগর প্রেস, বোম্বাই দ্বারা প্রকাশিত হয়। এত অধ্যায় ছিল সাইত্রিশটি। এটিই নাট্যশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন পূর্ণ মুদ্রিত সংস্করণ। এরপর এই গ্রন্থের সংশোধিত সংস্করণ আবার ১৯৪৩ সালে নির্ণয়সাগর প্রেস, বোম্বাই থেকেই প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণে অধ্যায় সংখ্যা কমে হয় ৩৬টি। নাট্যশাস্ত্রের আরেকটি পূর্ণ সংস্করণ ১৯২৯ সালে চৌখাম্বা সংস্কৃত সিরিজ, বারাণসী থেকে প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণে ছিল মোট ৩৬টি অধ্যায়। এর পান্ডুলিপি সরস্বতী ভবন গ্রন্থালয়, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, বারাণসীতে সংরক্ষিত আছে। এভাবে এই দুটি গ্রন্থই নাট্যশাস্ত্রের পূর্ণ সংস্করণ।
কাব্যমালা সংস্করণের প্রকাশনার পরে, প্রফেসর রামকৃষ্ণ কবি গায়কওয়াড় ওরিয়েন্টাল সংস্করণ, বরোদা থেকে অভিনভগুপ্তের ‘অভিনভভারতী’ টীকা সহ নাট্যশাস্ত্রকে চারটি ভাগে প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম ভাগ প্রথম সাতটি অধ্যায় নিয়ে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় ভাগে ছিল আট থেকে আঠেরো তম অধ্যায় যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। তৃতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় সাতাশতম অধ্যায় পর্যন্ত ১৯৫৪ সালে, এবং বাকি অধ্যায় অর্থাৎ আটাশ থেকে ছত্রিশতম অধ্যায়, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য এই প্রকাশনায় তিনি মোট চল্লিশটি পান্ডুলিপি ব্যবহার করেছিলেন। এরপর ১৯৫৬ সালে, শ্রী রামস্বামী শাস্ত্রী গায়কওয়াড় সংস্কৃত সিরিজ থেকেই প্রথম অংশের (১-৭) পুনরায় সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। এই সংস্করণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এবং পাঠান্তর করেছিলেন।
মনমোহন ঘোষ মহাশয়ের নাট্যশাস্ত্রের ১-২৭ অধ্যায়ের প্রথম ইংরেজি সংস্করণ, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা থেকে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর ১৯৫৬ সালে তিনি আবার সম্পূর্ণ নাট্যশাস্ত্রের মূলপাঠ প্রকাশ করেছিলেন। এই ক্রমে তিনি ১৯৬১ সালে নাট্যশাস্ত্রের ২৮-৩৭ অধ্যায় ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এইভাবে এম.এম. ঘোষ সম্পূর্ণ নাট্যশাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ সহ প্রকাশ করেছিলেন। ঘোষ এই অনুবাদের পাদটিপ্পনীতে অনেক প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সংস্করণগুলি ব্যবহার করেছিলেন এবং প্রথমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন। এই সংস্করণটি যদি কেউ পড়তে চান, তাহলে আমার মনে হয়, উইসডম লাইব্রেরিতে আছে ভাগে ভাগে, পুরোটাই; এছাড়া ইন্টারনেট আর্কাইভেও বইটি পাওয়া যায়।
এর বাইরে, আচার্য বিশ্বেশ্বর ১৯৬০ সালে ‘নাট্যশাস্ত্রের প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘অভিনভভারতী’ এর হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। বাবুলাল শুক্লশাস্ত্রী নাট্যশাস্ত্রের মূল অংশের হিন্দি অনুবাদ চারটি ভাগে চৌখাম্বা থেকে প্রকাশিত হয়। আচার্য মধুসূদন শাস্ত্রী ১-২৭ অধ্যায় পর্যন্ত নাট্যশাস্ত্রের একটি সংস্করণ হিন্দি অনুবাদ সহ তিনটি ভাগে প্রকাশ করেছিলেন, যা কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল। নাট্যশাস্ত্রের প্রথম এবং বোধ হয় একমাত্র বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয় ডঃ সুরেশ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নবপত্র প্রকাশন থেকে ১৯৫২ সালে (সম্ভবত); যা চৌখাম্বা প্রকাশনের অনুকরণে বলেই আমার ধারণা। এছাড়া সুরেশ্চন্দ্রবাবু রামকৃষ্ণ কবির সংস্করণটিও অধ্যয়ন করেছিলেন অনুমান করা যায়। চারটি খণ্ড মিলিয়ে সেই সংস্করণে মোট অধ্যায় সংখ্যা সাঁইত্রিশ। কিন্তু বাংলা ভাষায় এখনও অভিনবভারতীর কোনো সংস্করণ আছে বলে আমার জানা নেই। এবং অভিনবভারতী, অর্থাৎ আচার্য অভিনবগুপ্তের টীকা ছাড়া নাট্যশাস্ত্রের অধ্যয়ন আজ আমার প্রায় অসম্ভবই বলে মনে হয়।
তাহলে রবীন্দ্রনাথ যে নাট্যশাস্ত্রটি পাঠ করেছিলেন তা অবশ্যই ১৮৯৪ এর নির্ণয়সাগরের সংস্করণ; মানে একদম প্রথম ভারতীয় সম্পূর্ণ সংস্করণ সাইত্রিশ অধ্যায়ের। এবং আমার অনুমান তা সেই দশকেই। কারণ, রবীন্দ্রনাথের নাট্যচিন্তায় ভারতীয় নান্দনিকতার খোঁজ তথা একটি বিশাল বাঁকবদল আসে ১৯০০ সালের প্রায় শুরুর দিকেই যদি ভুল না করি। লেখক রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এই পাঠক রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে একটু বেশি ঈর্ষণীয়।
পাঠক হিসেবে বড্ডো অপরিপক্ক হওয়ায় ঈর্ষার মাত্রাটা আরো বেশি আমার…..
আমারও কম নয়
হাহাহা….