শ্রীকৃষ্ণ যতই গীতাতে ব্রহ্মজ্ঞানের দিকনির্দেশ করুন না কেন, এবং যতই ফলের আশাকে মানবের অনধিকার চর্চা বলে উপদেশ দিন না কেন, অর্জুন যদি সেই জ্ঞানের মধ্যে নিজের বিষাদমুক্তির আশ্বাস না পেতেন, তাহলে শ্রোতা হিসেবে অর্জুনের ভূমিকা কতখানি সার্থক হতো, এই নিয়ে আমার সংশয় আছে। এমনকি অর্জুনও যদি প্রকৃত অধিকারী না হতেন, তাহলে কৃষ্ণও কি অর্জুনের সামনে যে বিদ্যা গুহ্য, তা প্রকাশ করতেন? জানি না। আমি কুরুক্ষেত্রকে এখানে ভৌম কুরুক্ষেত্ররূপেই ধরে নিলাম।
আমাদের আলোচনার এখন প্রথম প্রহর। দিন আসতে ঢের বাকি। মীমাংসাশ্লোকবার্তিকের প্রথম অধ্যায়ে গ্রন্থের শুরুতেই কুমারিলভট্ট অপূর্ব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কেন শুরুতেই আলোচকের উচিত আলোচনার দিশা ও গন্তব্য নির্ধারণ করে দেওয়া। লক্ষ্য নির্দিষ্ট না হলে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েই যায়।
সবেস্যৈব হি শাস্ত্রস্য কর্মণো বা ঽপি কস্য চিৎ ।
যাবৎ প্রয়োজনং নোক্তং তাবৎ তৎ কেন মৃষ্যতে ॥১২॥
সবেস্যৈব: আসলেই
হি: (পূর্ববর্তী শব্দকে জোর দেয়)
শাস্ত্রস্য: শাস্ত্রের
কর্মণো বা ঽপি কস্য চিৎ: অথবা যেকোনো কর্মের
যাবৎ প্রয়োজনং: যতক্ষণ না প্রয়োজন
নোক্তং: বলা হয়নি
তাবৎ তৎ কেন মৃষ্যতে: ততক্ষণ তা কেউ বুঝতে পারে না
অর্থাৎ প্রতিটি শাস্ত্র বা কাজের নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ শাস্ত্রের বা কাজের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারে না।
…ন শুশ্রূষায়িতুং শক্যা প্রাগনুক্তবা প্রয়োজনম্ ॥১৩॥
ন শুশ্রূষায়িতুং শক্যা: কৌতূহল বা শোনার ইচ্ছা উদ্রেক করা সম্ভব নয়
প্রাগনুক্তবা প্রয়োজনম্: যতক্ষণ না পূর্বেই প্রয়োজন উল্লেখ করা হয়েছে
অর্থাৎ কৌতূহল বা শোনার ইচ্ছা তৈরি করা সম্ভব নয়, যদি না আগে থেকেই সেই কাজের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়।
… অনথেপ্রাপণং তাবত্তেভ্যো নাশঙ্ক্যতে ক চিৎ ॥১৪॥
অনথেপ্রাপণং: কোনও ভুল বোঝাবুঝি বা বিভ্রান্তি নেই
তাবত্তেভ্যো: তাদের থেকে (এই ধরনের ক্ষেত্রে)
নাশঙ্ক্যতে ক চিৎ: কোনও ভয় বা আশঙ্কা নেই
অর্থাৎ যখন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ভালোভাবে বোঝা যায়, তখন বিভ্রান্তি বা ভুল বোঝাবুঝির কোনও ভয় নেই।
আমি তাঁর এই কথাগুলিকে শিরোধার্য করেই আমার এই আলোচনাটিও তাই শুরু করেছি। গন্তব্য এখানে নির্ধারিত। এই কর্ম সকাম। আলোচনার বিষয় ও উদ্দেশ্য পাঠের আগেই নির্ধারণ করে দিয়ে পাঠকের মনে কৌতূহলের উদ্রেক ঘটানো আমার ইচ্ছা। আর কৌতূহল যার আছে, ইচ্ছা তাঁকে একটি দিশা দেওয়া। অভিনবগুপ্তও তো কৌতূহলকেই অধিকারীর অধিকার বলছেন। অর্জুনের কৌতূহল ছিল। সেই কৌতূহলই তাঁকেও কি গীতার অধিকারী করেনি?
এতদূরের আলোচনায় কালের হিসেবে জানি না কত, তবে শব্দপ্রয়োগের গণিতে প্রায় তিনহাজার একক পেরোনোর পর অতএব একটু অবকাশ পাওয়া গেল জিরিয়ে নেওয়ার। এই ক্লান্তির কোনো গ্লানি নেই কিন্তু। আজ থেকে দশ বছর আগে, সেই অচেতন লাইব্রেরীতে কয়েকটি বই দেখে এক নবীন পাঠকের ইচ্ছে হয়েছিল, পড়ার। এক নিবিড় পাঠের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে টেনে নিয়ে এসেছিল গ্ল্যামারের এই কসমোপলিটন বাজারে। পাঠ তাঁর হয়নি। বদলে সে পেল দলীয় কোন্দল। সিঁড়ি হিসেবে সে চিনল ম্যানিপুলেশনকে। সে শিখল সরকারি গ্রান্টের সুনিবিড় মুনশিয়ানা। সে দেখল দখল; অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অভিজ্ঞতায় সে এখন তুখোড় মানুষের আদিম বন্য প্রবৃত্তি বিষয়ে। আজ থেকে বছর দশেক আগে কৈশোরে অর্জিত সমস্ত গ্লানি নিয়ে সে যে মাঝে মধ্যে গিয়ে দাঁড়াত মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য-এর সামনে; প্রতিভার সেই ব্যাপকতা তাঁর কাছে পাহাড় প্রমাণ নয়, বরং মনে হয়েছে যেন প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ। সে গাছ কথা বলে না। সে গাছ কেবলই ছায়া দেয়।
গায়ত্রী যে নিজের মোহ আবরণ উন্মোচন করেন একমাত্র ধ্যানের ভিতর, এ সত্য থেকে আমাদের এই মধুকিশোর এখনও বঞ্চিত। পাঠ ও অধ্যয়নের মধ্যে পার্থক্য তাকে বুঝিয়ে দেবে কে? কে তাকে চিনিয়ে দেবে ওরে ওটা ধ্যান নয়, ধ্যানের মিমিক্রি?
– জীবন!
সে হাল ছেড়ে দেয়। পথ হারিয়ে ফেলে।
অতএব পাঠক কৌতূহল থাকলেই যে অর্থ সিদ্ধ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কৌতুহল আপনার কাম। অর্থ আপনার বিকল্প, উপায়। তা সিদ্ধ হবে ধর্ম দিয়ে। ধর্মই গুরু। প্রকৃত গুরু ছাড়া এই মায়াবী অন্ধকারে আলো জ্বালবে কে? মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য-এর প্রতি তাঁর নির্বাক প্রার্থনা অতএব পূরণ হলো বছর সাতেক পর। কিন্তু সে তো ততদিনে পথ হারিয়ে, হাল ছেড়ে বসে আছে। পথ হারিয়ে ফেলার পরই কি প্রকৃত পথের হদিশ পাওয়া যায়? ব্যথায় কি আনন্দের উৎস? জানা নেই। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার পরই সে পেল হাল না ছাড়ার মন্ত্র, চিদাকাশে। সে পেল তাঁকে, যে সান্নিধ্যে এলে সে জানতে পারল অজ্ঞানের তিমির অন্ধকার দূর হওয়ার ম্যাজিক। এই উপলব্ধি তাঁর হলো, কলকাতা থেকে একটু দূরে। পৌষের শীতে, বছর তিনেক আগেও যেখানে সে শুনেছে শৃগালের চিৎকার।
তিনি আমাকে মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছেন, ‘কখনও হাল ছাড়তে নেই’। আমি তাই আর হাল ছাড়ি না। প্রচণ্ড ঘুর্ণির মাঝে তিনি আমাকে চিনিয়েছেন শান্ত উচ্চারণ। যেখানে কোনো ঝড় নেই, ঝঞ্ঝা নেই। ভাষা আমার সংস্কার। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন তাঁর সূক্ষ্ম প্রয়োগ, তিনি দিয়েছেন জ্ঞান। আমি তাঁর পরম্পরায়, তাঁরই কথা আপনার সামনে পরিবেশন করছি। অতএব এই উচ্চারণে যা কিছু সত্য সবই তাঁর, যা কিছু ভুল, তাকে অধমের বলে জেনে নিতে হবে। জীবনের প্রায় তিনটি দশক ধরে তিনি জড়ো করেছিলেন যা, নবীন এক শিশিক্ষুকে সেই জ্ঞান তুলে দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি। তিনি আমাকে দিয়েছেন দায়িত্ব, ‘তোমাকে তো অনেক কাজ করতে হবে দেশের জন্য, ভারতীয় নাট্য পরম্পরা নিয়ে’। ভারতীয় নাট্য পরম্পরা, ভরতের নাট্য পরম্পরা, মার্গীয় নাট্য পরম্পরা। যে নাট্য ক্রীড়নীয়কম, প্রসন্নজি উল্লিখিত খেলনা(প্লে) নয়(ইণ্ডিয়ান মেথড ইন অ্যাক্টিং, প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। যে নাট্য আনন্দের আস্বাদ দেয়, যে নাট্য ক্ষণিকের জন্য হলেও এই জগতের কার্য-কারণ থেকে আপনাকে মুক্তির স্বাদ দেয়।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
২০১৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, গিরিশ মঞ্চে আমি প্রথম এই মার্গনাট্য দেখি। তাঁর সঙ্গে আমার সেই প্রথম আলাপ। তাঁর সেই নাট্যের নাম ‘ভাণক’। লৌকিকে অলৌকিকের আমার প্রথম আস্বাদ। স্বাদকে কি আর ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব? অথচ মুশকিলটা হলো তার পরে। প্রথম আলাপে আমি আশা করেছিলাম তাঁর কাছে কিছু স্পিরিচুয়াল কথা, তিনি বরং বললেন, “আমরা আগে মাথার ভিতর নিজের মতন করে একটা সিদ্ধান্ত কল্পনা করে নিই, তারপর তাঁর পিছনে যুক্তি সাজাই। যুক্তিকে অনুসরণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটাই তো আসল যাত্রা, তাই না কি?” তিনি সেদিন আরও বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। নিশ্চয়ই বলেছিলেন। আমার মনে নেই। যেটুকু মনে আছে, তা কেবল মুগ্ধতা। লোকে তাঁকে চেনেন শ্রী পিয়াল ভট্টাচার্য্য (মহামহোপাধ্যায় উপাধি নটবরী কথক নৃত্য অকাদেমী প্রদত্ত) নামে; মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য-এর সঙ্গে যেকোনো মিল, নিছক কাকতালীয় নয়।
সেদিন ভাণকের অভিনয় শুরু হয়েছিল বাক্যপদীয় ব্রহ্মকাণ্ডের প্রথম কারিকা, “অনাদিনিধনং ব্রহ্ম শব্দতত্ত্বং যদক্ষরম…” দিয়ে। আদিঅন্তহীন শব্দতত্ত্ব ব্রহ্মস্বরূপ অক্ষর। আর শেষ হয়েছিল, নাট্যশাস্ত্রের ৩৬ তম অধ্যায়ের ৭৮-৭৯ নম্বর কারিকা দিয়ে।
য ইদং শৃণুয়ান্নিত্যং প্রোক্তঞ্শ্চেদং স্বয়ম্ভুবা ।
প্রয়োগং যশ্চ কুর্বীত প্রেক্ষতে চাবধানবান্ ॥ ৭৮ ॥
যা গতির্বেদবিদুষাং যা গতির্যজ্ঞকারিণাম্ ।
যা গতির্দানশীলানাং তাং গতিং প্রাপ্নুয়ান্নরঃ ॥ ৭৯ ॥
যঃ ইদং শৃণুয়াৎ নিত্যং – এটা যে নিত্য শোনে
প্রোক্তং চ ইদং স্বয়ম্ভুবা – স্বয়ম্ভূ যেমন বলে গেছেন
প্রয়োগং যঃ চ কুর্বীত – যিনি এর প্রয়োগ করেন
প্রেক্ষতে চ অবধানবান্ – এবং যিনি মন দিয়ে একে দেখেন
যা গতিঃ বেদবিদুষাং – বেদজ্ঞ ব্যক্তির যা গতি
যা গতিঃ যজ্ঞকারিণাম্ – যা গতি যজ্ঞকারীর হয়
যা গতিঃ দানশীলানাং – দানশীল ব্যক্তির যে গতি
তাং গতিং প্রাপ্নুয়াৎ নরঃ – সেই গতি যেন সেই ব্যক্তি লাভ করেন।
এটাই আমাদের আলোচ্য নাট্যের ফলাফল। এই ফলাফল কার? প্রয়োগকর্তা ও দর্শকের। প্রয়োগকর্তা অর্থাৎ নট ও কবি। ভরত নাট্যশাস্ত্রে দর্শক কথাটি উচ্চারণ করেন না। রসিক? না তাও না। তিনি বলেন সামাজিক। এই কবি, সামাজিক ও নট, নাট্যশাস্ত্রে অতএব এই তিনের অধিকার। আপনি এই তিনের যেই হোন না কেন পাঠক, যদি কৌতূহল জাগে, নাট্যশাস্ত্রে আপনার অধিকার কেউ খণ্ডাতে পারবে না। কথা দিলাম।
কবি, সামাজিক ও নট — তিন পর্বই আসলে একধরনের যাপন চর্চা ও চর্যাও বটে… যেই চর্চায় ও চর্যায় অধিকারী হওয়া যায়।
ত্রিপল্লব। শিব এতেই সন্তুষ্ট