আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগের কথা। সেই সত্যযুগ ও ত্রেতাযুগের সন্ধিক্ষণের কথা বলছি। মনে আছে তো আমাদের ভারতবর্ষের চার যুগের কথা? সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি? সেই সত্যযুগ ও ত্রেতাযুগের সন্ধিকাল। অর্থাৎ সত্যযুগ শেষ হয়ে যখন সবে ত্রেতাযুগ শুরু হয়েছে। আমরা জানি, সত্য যুগে মানুষের কোনো দুঃখ ছিল না, কারণ মানুষের মনে কোনো কামনা ছিল না। মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল, আধ্যাত্মিক মনোভাবের ফলে গোটা সমাজ এমনকি সমাজের প্রশাসকেরাও ছিলেন নিশ্চিন্তে। সেই সময় রাজা তথা প্রভু বলতে আসলে ছিলেন লোকপাল। অর্থাৎ লোকের পালনকর্তা। দক্ষিণলোকপাল যম, উত্তরলোকপাল কুবের, পশ্চিমলোকপাল বরুণ এবং পুর্বের লোকপাল ইন্দ্র। তাঁদের শাসনে সমাজে ছিল এক সুন্দর সমন্বয়। কিন্তু এই সাম্য-সৌম্য-সুন্দর তো থাকার নয়। আর থাকলে গল্পই বা তৈরি হবে কী করে! ফলে কালের নিয়ম মেনে সময় এল ত্রেতাযুগের। কোথায়? আমাদের জম্বুদ্বীপে।
জম্বুদ্বীপ অর্থাৎ বৃহত্তর ভারতবর্ষ। রাম আসবেন তাই ত্রেতাযুগ এল; কিন্তু ত্রেতাযুগের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বেড়ে গেল গ্রাম্যধর্ম। গ্রাম্যধর্ম অর্থাৎ? সুখ-দুঃখ-ভোগ-ঈর্ষা-শান্তি-অশান্তি-কামনা-বাসনা ইত্যাদির বোধ। এখন মানুষের মনে চঞ্চলতা থাকলে সে মন অধ্যয়নে কীভাবে মনোনিবেশ করবে! চারটি বেদ পাঠের জন্য তো চাই ব্রাহ্মণ মন। তাই বিচক্ষণ ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতারা এই গ্রাম্যধর্ম থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেতে ঠিক করলেন যে তাঁদের এমন একটা মনোবিনোদের উপায় দরকার যা তাঁদের বেদের প্রজ্ঞা তথা আত্মজ্ঞানও দেবে কিন্তু খেলাচ্ছলে।
এই দাবি নিয়ে তাঁরা পৌঁছোলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। দাবি? এমন এক খেলা আপনি আমাদের দিন, যাতে বেদের আত্মজ্ঞান লাভ হবে, কিন্তু তা হবে সর্ববর্ণিক। সর্ববর্ণিক অর্থাৎ, যা চতুর্বণের জন্য। চতুর্বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-এবং শূদ্র এরা সকলেই হবে যার অধিকারী। এমন অনুরোধ শুনে ব্রহ্মা তাই আবার ধ্যানে বসলেন, এবং স্মরণ করতে থাকলেন চতুর্বেদের সমস্ত তত্ত্ব। তিনি ঋকবেদ থেকে নিলেন কথা, সামবেদ থেকে নিলেন সঙ্গীত, যজুর্বেদ থেকে নিলেন অভিনয় এবং অবশেষে অথর্ববেদ থেকে রস সংগ্রহ করে জগৎকল্যাণের উদ্দেশে রচনা করলেন পঞ্চম বেদ, সমস্ত শাস্ত্রের সারাৎসার, সমস্ত শিল্পের ভিত্তি, নাট্যবেদ।
নাট্যবেদ রচনা সম্পন্ন হলে ব্রহ্মা ইন্দ্রকে নির্দেশ দিলেন একমাত্র দক্ষ, বিদগ্ধ, প্রগলভ এবং পরিশ্রমী যারা তাঁরাই এই নাট্যচর্চার আসল অধিকারী। পিতামহের কথা শুনে ইন্দ্র বেশ বুঝতে পারলেন যে পরিশ্রমের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা দেবতাদের সাধ্য নয়, অতএব ডাক পড়ল বেদজ্ঞ ঋষিদের। এই অন্য অনেক ঋষিদের মধ্যে একজন আমাদের ভরত, যিনি তাঁর একশত পুত্রকে যথাতত্ত্ব নাট্যশিক্ষায় শিক্ষিত করেন, এবং ত্রিবৃত্তিযোগে প্রথম নাট্য উপস্থাপন করেন পিতামহের সামনে। ত্রিবৃত্তি অর্থাৎ ভারতী, সাত্ত্বতী এবং আড়ভটি।
এই উপস্থাপনা দেখে ভরতকে ব্রহ্মা উপদেশ দেন, কৈশিকী বৃত্তি সংযোজনের। ভরত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, তিনি এই কৈশিকী বৃত্তি দেখেছেন মহাদেবের নাচে, তাই যদি অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলে মহাদেবের সেই অঙ্গহার নাট্যে সংযোজন করা যেতে পারে। এছাড়া আরও বলেন, তাঁর শত পুত্র যারা অভিনয় করছেন তাঁদের পক্ষে কৈশিকী বৃত্তির সম্যক প্রয়োগ একটু মুশকিলেরই। ব্রহ্মা ভরতের কথার অর্থ বুঝতে পেরে, সৃষ্টি করেন তাঁর মানস কন্যা অপ্সরাদের। তিনি ভরতকে মহাদেবের কাছে নৃত্যশিক্ষা ও তা প্রয়োগের অনুমতিও দেন। নাট্যে সঙ্গীত প্রয়োগের জন্য দায়িত্ব দেন স্বাতীকে, এবং নারদ এবং গন্ধর্বদের দায়িত্ব দেন গান রচনার। মহাদেব ভরতের অনুরোধ শুনে, নিজ শিষ্য নন্দীকে নির্দেশ দেন, নাট্যোপযোগী, একশো আটটি করণ ভরতকে শেখানোর। এইভাবে গীত-নৃত্য-এবং বাদ্য সহযোগে দুই গুরুর নিকট অধ্যয়নের পর, ভরত নাট্য নির্মাণ করেন ব্রহ্মা রচিত ইতিহাস, সমুদ্রমন্থন। স্থির হয় ইন্দ্রের ধ্বজা-উৎসবে হবে প্রথম নাট্যের প্রথম অভিনয়।
দর্শকাসনে বসে সুরাসুর। নান্দীর পর ভরত তাঁর নাট্যপ্রদর্শন শুরু করেন। নাট্যপ্রদর্শনে প্রীত হয়ে ইন্দ্র তাঁদের উপহার দেন নিজস্ব ধ্বজা, ব্রহ্মা দেন কুটিলক, বরুণ দেন সোনার কলস, সূর্যদেব দেন ছাতা, মহাদেব দেন সিদ্ধি, বায়ুদেবতা দেন পাখা, বিষ্ণু দেন সিংহাসন এবং দেবী সরস্বতী দেন শিল্পদক্ষতা।
আচ্ছা আমরা সমুদ্রমন্থনের গল্প নিশ্চয়ই জানি। দেব-দৈত্য-দানব-পর্বত প্রত্যেকের সহযোগিতায় কীভাবে অমৃত মন্থন করা হয়েছিল। অমৃত মন্থনের ফলে উত্থিত বিষ পান করেছিলেন শিব; কীভাবে বিষ্ণু মোহিনীর রূপ ধরে অসুরদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন অমৃতভাণ্ড? কীভাবে জন্ম হয়েছিল রাহুকেতু-র? নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি! ভরত যোগের এই গুপ্তবিদ্যাকে নাট্যের মাধ্যমে প্রদর্শন করছিলেন আবার দেবতা ও অসুরদের সামনে। উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসের মধ্যে যেটি উচিত সেটির কথা পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়া বিনোদনের মাধ্যমে। কিন্তু নাট্যে নিজেদের পরাজয় দেখে, বিঘ্নরূপ দানবেরা, খুব বেশিক্ষণ অবজেক্টিভ থাকতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়, ডেকে এনে অপমান করা হচ্ছে এবং তাই তাঁরা এই নাট্যের বিরোধ করতে থাকেন। সৃষ্টি করেন নানাবিধ বিঘ্ন নাট্যকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার। এই বিঘ্নদূরীকরণে ইন্দ্র নিজের জর্জর প্রয়োগ করেন এবং সাময়িকভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়; দেবতারা আবার ব্রহ্মার কাছে যান এর উপায় খুঁজতে, অসুরেরাও ব্রহ্মার কাছে যান নালিশ করতে পক্ষপাতের। কেন দুইপক্ষেরই পিতামহ হওয়া সত্ত্বেও ব্রহ্মা দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব করছেন, আর ভরত কী করবেন বুঝতে না পেরে হয়ে যান কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
এই বিঘ্নদূরীকরণে অতএব তাই ব্রহ্মা নিয়োগ করেন বিশ্বকর্মাকে নাট্যমণ্ডপ নির্মাণ করার জন্য। এবং সেই মণ্ডপের চারটি স্তম্ভ নির্মিত হয় চতুর্বণের শক্তি দিয়ে। দেবতাদের উপদেশ দেন, সমস্ত শাস্ত্রের সারাৎসার এই খেলা যেমন তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন, এবং পেয়েওছেন, তাই তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্বও নিতে হবে তাঁদেরই। বারবার পিতামহের কাছে ছুটে আসা খুব একটা উচিত কাজ নয়। এবং অবশেষে অসুরদের উপদেশ দেন, অনাসক্তির। একটি ইতিহাসকে যেন ইতিহাস হিসেবেই দেখা হয়, তার প্রতি আবেগে জড়িয়ে পড়া অনুচিত। দর্শক হিসেবে রসাস্বাদনে মানসিক পরিপক্বতা কাম্য।
এই ছিল আমাদের নাট্যোৎপত্তির গল্প। বলা বাহুল্য এটি রূপকাশ্রিত, সংবাদ প্রতিবেদনের মতন পাঠ কর্তব্য নয়। বুদ্ধিমান পাঠকের এই গল্পের সাধারণীকরণ করে নিতে অসুবিধে হবে এমনটা আমার বিশ্বাস নয়, তবে পরম্পরাগত পাঠ গল্পটির মর্মার্থ বুঝতে অবশ্যই সাহায্য করবে। পাঠক আপনি রসের আস্বাদ নিন; আমি আর ব্যাখ্যার মধ্যে গিয়ে আপনার এই রসাস্বাদনে বিঘ্ন তৈরি করতে চাই না।
“হেন কোনো জ্ঞান নেই, শিল্প নেই, বিদ্যা নেই কলা,
বাকি কোনো যোগ নেই, কর্ম নেই, নাটকে অবলা” ।। ১, ১১৮।।