হঠাৎ খেয়াল করে সব কিছুই কেমন শান্ত হয়ে গেছে। গাড়ি চলছে, রাস্তায় টায়ার ঘষার আওয়াজও আছে। কিন্তু এতক্ষণ যে বলিউড মেলোডিগুলো ড্রাইভার বাজাচ্ছিল, স্পিকারে, সেটা নেই। ওর মন বা কান সে দিকে ছিল না। তাই সে মনে করতেও পারে না, শেষ গানটা কী বাজছিল। তবু যাই হোক, ওই শব্দ ভরিয়ে রেখেছিল চারপাশ। এখন খালি খালি লাগছে। কেমন অস্বস্তি করতে লাগলো ওর। সে একটু উঠে সামনের দিকে উঁকি দিয়ে গান বন্ধ হওয়ার কারণটা বোঝার চেষ্টা করতেই দেখল, ঠিক ওর তিনটে রো আগে বসা সুশ্রুতদা নিজের সরোদ বের করেছে। বাসের সামনের দিকে খোলা একটা জানলা টাইট করে বন্ধ করছে কবীর, সে দলের বাঁশিবাদক। সুশ্রুতদার পাশ থেকে উঠে এসে ওকে একা ওর সরোদ নিয়ে বসার জায়গা করে দিচ্ছে বিনয়দা, পারকাশনিস্ট, পাখোয়াজ বের করল তন্ময়, বাসের মধ্যে এসরাজ বাজিয়ে লাভ নেই বলেই বোধ হয় সৌরভ শ্রোতার ভূমিকায়। টুংটাং করে যন্ত্রটা একটু টিউন করেই সুশ্রুতদা শুরু করল। রাত্তির এখন দুটো। এমন সময় হংসধ্বনির অকালবোধন করছে এরা। কয়েকমাস হলো রণিদার পরামর্শে কৌরব ধ্রুপদের তালিম নেওয়া শুরু করেছে। এখনও রাগরাগিণী সম্বন্ধে সম্যক ধারণা জন্মায়নি ওর। ফলে এসব বিষয়ে কবীরের প্রতিই বেশি নির্ভর করে সে। বয়সে কবীর ওর চেয়ে বছর চারেকের বড়ো। কিন্তু দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব এমনই যে কৌরব ওকে নাম ধরেই ডাকে। কবীর ওকে রাগ চিনিয়ে দেয়। তবে সুশ্রুতদা এখন যেটা ধরেছে সেটা যে হংসধ্বনি সেটা চিনতে কৌরবের অসুবিধে হলো না। এই সুর সে শেষ দুমাস ধরে প্রায় রোজ শুনছে। সেইরাতে পরের এক থেকে দেড় ঘণ্টা একটানা ওরা হংসধ্বনি-দেশ-দূর্গা বাজিয়েছিল। কৌরব বলে একজন যে ওদের সঙ্গেই আছে সে বিষয়ে কারুরই তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সব্বাই হয়তো এটাই ভেবেছিল যে ও ঘুমাচ্ছে; কিংবা ওর কথা হয়তো ওদের মাথাতেই আসেনি। কৌরবেরও এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা কোনোওদিনই নেই। কিন্তু যখন সুশ্রুত দেশ রাগটা ধরে, কৌরবের ভিতরে জমে থাকা কান্না আচমকাই বেড়িয়ে এলে, ঠিক ওই মুহুর্তটাই একটা খরগোশের গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়তে চেয়েছিল সে, জঙ্গলের আড়ালে, চেনা মানুষদের থেকে দূরে, কিছুক্ষণের জন্য আলাদা।
মৃত আর জীবিতের মধ্যে পার্থক্য করা যায় যেকোনো আঘাতের প্রতি তাদের আচরণ দেখে। এই প্রতিক্রিয়ারই অপর নাম অভিনয়? শেক্সপীয়র পৃথিবী যে একটা গোটা রঙ্গমঞ্চ এই লেবেল সাঁটিয়েছিলেন। বাজিকরের এই খেলায় পুতুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রত্যেকটি সংলাপই আসলে শিল্প। পুতুলের বেঁচে থাকার প্রমাণ। দর্শক কেবলই শোনেন এই সংলাপ, যাকে আমরা কখনও কখনও কবিতা বলি, আর সেটাই একজন অভিনেতা পড়েন। অথচ একটি কাগজের উপর কলমের কতখানি চাপ থাকলে সেই অলৌকিক জিঘাংসাকে নান্দনিকতায় মুড়ে ফেলা যায়, কোনও এস আই বা সিজিএস পদ্ধতিতে তার পরিমাপ সম্ভব নয়। অথচ এত রক্তক্ষয়ী রণ ও রিহার্সালের পরে একদিন পুতুল তার বাজিকরের ইশারায় ইজ্জত লুটিয়ে নাচতে গিয়ে যখন নিজস্ব সংলাপ ভুলে যায়, সেই ক্যাথারসিসে ভিজে গেছে কৌরব। গাড়ির ভিতরে গান ততক্ষণে থেমে গেছে। জানলার ওপার থেকে আসা মসলিনের মতন এই জ্যোৎস্নাকেই তখন নিজের সারা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সে। অজন্তা গুহার দেয়ালে খোদায় করা বুদ্ধের শরীরের পোশাকের মতন নির্লিপ্ত স্বচ্ছ এই জ্যোৎস্না, যেন অনন্তকাল ধরে চাঁদের গোমুখে জন্ম নেওয়া এক কালস্রোত। এই স্রোতেই যেন নোয়া ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নিজের নাও, সেই স্রোতেই যেন বসন্ত আক্রান্ত লালু পেয়েছিল ফকির জীবন। স্ট্রিং থিয়োরি মনে পড়ে কৌরবের। চোখের সামনে সমস্ত গাছপালাসহ প্রকৃতি ও মানবইতিহাসের আরেকটি প্যারালাল ইউনিভার্স দেখতে পায়। এগারো জগতের সবচেয়ে মোহময়ী সংখ্যা, নিজের ভিতরে এগারোটি ডাইমেনশনের সম্মিলিত উদ্দামতায় মহামায়াকে অনুভব করা শুরু করে সে। চাঁদের থেকে দৃষ্টি ফেরে না। সেই পথেই ও দেখতে পায় ধীরে ধীরে ওরই দিকে নেমে আসছেন স্বয়ং মহাদেব। কৌরবের ইরেকশন হয়ে যায়।
ঘড়িতে তখন সময় সাড়ে তিনটে। দুটো ফোর্স ট্রাভেল মিনিবাস মাঝরাত্তিরে তার প্যাসেঞ্জারদের হিসি করার জন্য রাস্তার এক পাশে কিছুক্ষণের জন্য থেমেছে। দুটো গাড়ির প্রায় সকলেই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নীচে নামলেও, কৌরবের চোখ পড়ল আলাদা করে ঈশিতের উপর। লম্বা চেহারা, ফর্সা, নীল রঙা আকাশের ব্যাকড্রপের সামনে লেদার জ্যাকেটটাকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট ওর নেশা নয় পরিচয় আর কনফিডেন্স ওর গ্ল্যামারের অপর নাম। কী মনে করে নিজের পার্স থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করল কৌরব। অপূর্ব সরকার, প্রোপ্রাইটার, হামফারা পাবলিশার্স। ঈশিতের কাছ থেকেই পাওয়া।
শো তখন সবেমাত্র ভেঙেছে। শুধুমাত্র পোশাক চেঞ্জ করে, মেক আপ না তুলেই ঈশিত মঞ্চের পিছনে একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। একটি শো ভাঙার পর সবচেয়ে বিরক্তিকর যে জিনিসটার সম্মুখীন হতে হয় তা হল গ্রিনরুমের ভিতরে দর্শকদের অবাধ বিচরণ। ঈশিত এটা একদম নিতে পারে না। একবার সিদ্ধার্থদার সঙ্গে এই নিয়ে ওর চরম বচসা বাধে। কৌরবকে সে তখন তার এই মনোভাবের পিছনে যুক্তি হিসেবে বলেছিল যে যদি কখনও কৌরবের পার্সোনাল রুমে, কৌরব যখন ন্যাংটো হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করছে তখন সে যদি উইদাউট পারমিশন দরজা খুলে ঢুকে পড়ে, তাহলে কেমন লাগবে। কৌরব জবাবে বলেছিল নিজের বাড়ি একটা প্রাইভেট স্পেস, আর মঞ্চ পাবলিক। ঈশিত উত্তেজিত হয়ে জবাব দেয়, “গ্রিনরুম একজন অভিনেতার বাড়ি, সেখানে সেও ঐ প্রাইভেসি ডিসার্ভ করে।” ব্যাঙ্গালোরে কলকাতার এই কালচার নেই। কিন্তু এইসময়টায় সিগারেট ধরানো ঈশিতের অভ্যেস হয়ে গেছে। টেকনিশিয়ানদের সমস্ত ইক্যুইপমেন্ট খুলে নামানো পর্যন্ত মঞ্চে কৌরবের এখন কোন কাজ নেই। সেও একটু রিলিফের জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিল। ঈশিতকে দেখে এগিয়ে আসে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে, ঈশিতের কাছ থেকে লাইটার নিয়ে আগুন ধরায়। একটি লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে ঈশিতকে প্রশ্ন করে ,
– কাল তাহলে দলে তোর শেষ শো?
– হুম
– এরপরের প্ল্যান কী?
– প্ল্যান কিছু নেই।
– তাহলে হঠাৎ করে ছেড়ে দিচ্ছিস কেন?
– স্ট্যান্ড মে বি।
– কীসের?
– বিস্ময়ের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা আমার ভালো লাগেনি।
এর পরের কিছুক্ষণের ডিসকোর্সে দুজনের মধ্যে যে আলোচনাটি হয়, তার মূল বিষয় ছিল বিস্ময়কে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে পুরুলিয়ায় একটি ছৌ ফেস্টিভ্যাল অর্গানাইজ করে একটি বিশেষ কালচারাল ওয়েবসাইট। একটি ফেলোশিপ সংক্রান্ত বিষয়ে রণিদার যোগাযোগেই মূলত সেটা কভার করার উদ্দেশ্যেই সেখানে যায় বিস্ময় ও ঈশিত। সেই অনুষ্ঠানের দুবছর পর ওই ফুটেজগুলো নিয়েই এডিট করে একটি ডকুমেন্টরি বানিয়ে কোন এক বিদেশি ফেস্টিভ্যালে পাঠিয়ে দেয় বিস্ময় এবং সেখানে তার এই ছবিটি নির্বাচিতও হয়, পুরস্কৃতও হয়। রণিদাকে সে ছবিটি দেখায় ও রণিদা ওকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি চুরি করার দোষে দল থেকে বের করে দেন। দলের সকলের কাছে এই তথ্যই সত্য হিসেবে প্রচার করা হয়। কৌরব ছবিটি দেখেছে, সেখানে বিস্ময় নিজের গুরুর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ভোলেনি। এই নিয়ে বিস্ময় শেষ কথা এটাই বলে ‘এডিট যার, ডকুমেন্টরি তার’। কিন্তু ফুটেজগুলোর স্বত্ব বিষয়ে বিস্ময়ের অভিমত ঠিক কী তা কৌরবের জানা হয়নি, আর কৌরব জিগ্যেস করেনি বলে বিস্ময়ও তাকে কিছু বলেনি। আজ আলাপ আলোচনায় ঈশিতের কাছ থেকে সে জানতে পারে, সেদিন দল থেকে তাদের একটি মাত্র হ্যান্ডিক্যাম আর টিকিটের ভাড়া ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয়নি। বিস্ময়ের নিজস্ব একটা ডিএসএলআর ছিল। অতএব সেই হিসেবে ওই ক্যামেরায় তোলা সমস্ত ফুটেজের স্বত্ব তার। আর যেহেতু সেই ভিডিওগুলো সে দলকে বিক্রি করিনি, তাই এই ঝামেলার পর, রণিদাকে না জানিয়েই বিস্ময়কে একটা এনওসি দিয়ে রেখেছে কৌরব। বিস্ময় তার কাজের ক্রেডিট লিস্টে কাউকেই ছোট করেনি, ফলে তার না বলার কোন জায়গাই নেই।
– কিন্তু বিস্ময়ের এটা করার দরকারই বা কি ছিল? ও নিজেও আরেকবার আলাদা করে গিয়ে কাজটা করতে পারত।
– কয়েকবছর আগে রণিদা ছৌ নিয়েই একটা ইংরাজি বই বিস্ময়কে দেয় অনুবাদ করতে। প্রবন্ধের বই ছিল। আমি নামটা ভুলে গেছি। সেই বইটি বিস্ময় প্রায় পুরোটাই অনুবাদ করে দেয় রণিদাকে। পরিহাসটা কী জানিস, রণিদা সেই অনুবাদটাকেই এদিক ওদিক করে নিজের নামে আইএসবিএন বের করে আর রণিদার ফেলোশিপটা টিকে যায়। বিস্ময় কিন্তু এই ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছু বলেনি।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.