সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ঘটনায় সারা দেশ যখন তোলপাড় তখন কৌরবের ক্লাস নয় এবং লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা এক। কৌরবের জগৎ ছোট ছিল। জীবনের প্রতিটা বাঁকে কীভাবে রাজনীতি লুকিয়ে থাকে, তা সে বুঝতো না। কিন্তু বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতি ওর পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, আর তাই আজকের মাননীয়া ওর বিরোধী। সিঙ্গুরের ঘটনায় ওর দাদু বামফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। ওকে তিনি বুঝিয়েছিলেন কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন। “তাহলে কেন তাঁর ছাব্বিশ দিনের অনশন?”
-কারণ ও বিরোধী!
এই ঘটনার কয়েকমাস বাদে, মার্চ মাসের চোদ্দো তারিখ, ওর দাদু একদম চুপ করে যায়। সেদিন রাত্তিরে কৌরব ঘুম থেকে উঠে তাঁকে চিরঘুমে তলিয়ে যেতে দেখে, আর কয়েকদিন পর টিভিতে দেখে সিভিল সোসাইটির মিছিল। সেই মিছিলেই সে প্রথম রণিদা-কে দেখে, আর দেখে অপর্ণা ঘোষকে, ওদের মুভমেন্টের অন্যতম লিডার। এক রাত্তির বেলা ডিনারের পর সব্বাই মিলে যখন আড্ডা দিচ্ছিল, তখন কথাপ্রসঙ্গে কৌরবের মুখে, “মিছিল রবীন্দ্র সদনের কাছে পৌঁছাতেই পুলিশের সঙ্গে মিছিলের ধ্বস্তাধ্বস্তি হয় ও পুলিশ অনেককে গ্রেফতার করে” এই কথাশুনে পর্ণাদি যারপরনাই হেসে ফেলেন। কৌরব বিষয়টা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালে পর্ণাদি নিজেকে সামলে নিয়ে ঘটনাটা বিস্তারিত বলেন। “আমি সেদিন ইস্কুলে। হঠাৎ দেখি বাবার ফোন। আমি ক্লাসের মাঝখানেই ফোন তুলেছি দুশ্চিন্তায়। কয়েকদিন আগেই বাইপাস সার্জারি করে বাড়ি ফিরে এসেছে বাবা। কী ঘটল আবার, এই ভেবে কল রিসিভ করতেই বাবার ধ্যাতানি, ‘কাকে বিয়ে করেছিস তুই! একটা ভীতু, পালিয়ে যাওয়া মাল। যেই পুলিশ সবাইকে গ্রেফতার করল ও সটান পালিয়ে গেল কোথায়? পুলিশের ভ্যানে ওকে দেখছি না কেন?’ আমি কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ‘বাবা, ক্লাসে আছি, পরে কথা বলছি’ বলে ফোন রেখে দিলাম। দেখছি ক্লাসের সমস্ত মেয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কোনওমতে ক্লাস শেষ করে, স্টাফরুমে ফেরার আগে আমি রণিকে ফোন করি,
- তুমি কোথায়?
- বাড়িতে।
- মিছিলে যাও নি?
- হ্যাঁ গেছিলাম। চলে এসেছি।
- মানে? ওখানে তো শুনলাম খুব ঝামেলা হয়েছে। বাকি ছেলেগুলো কোথায়?
- ওদের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।
- ওদের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, আর তুমি ভয় পেয়ে পালিয়ে এলে! ছিঃ ছিঃ”
কথা শেষ হতেই কৌরব রণিদার দিকে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকাতেই রণিদা বললেন, “জেলের ভিতর যখন ওরা ‘কারার ঐ লৌহকপাট গেয়ে আন্দোলন করছিল, তখন কে ছাড়াতে গেছিল শুনি?” “আহ্ সে যেন তুমি একা গেছিলে! সঙ্গে অতোজন না থাকলে তুমি যে কত যেতে সে আমার জানা হয়ে গেছে” পর্ণাদি চিমটি কাটেন। সিদ্ধার্থদা ঐ ঘটনায় জেলে গেছিল। তার কাছ থেকেই কৌরব শুনেছে সেদিন পুলিশের যে ডিসিডিডি অত্যন্ত ভদ্রভাবে দাদাগিরি করেছিলেন, ‘সেই তিনিই আজ মহানগরের অ্যাডিশনাল কমিশনার’। কৌরবের বাবা তখন সিউড়ীতে পোস্টেড; ফোন করে মা-কে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস আমি পুলিশে নেই’, মায়ের শ্বশুর-শ্বাশুরি-ননদ-জা বলেছিলেন, ‘যতই যা হোক, ক্ষমতায় তো আবার সেই বুদ্ধবাবুই আসবেন’, দিদা বলেছিলেন, ‘শিবম্’, দাদুঢ় বলার মতন কোনো শরীর ছিল না। মা তো আর বিকালে এসে সচরাচর ছেলের দেখা পেতেন না, কারণ ছেলে ততদিনে ‘লায়েক হয়ে গ্যাছে’।
কৌরবই এই মিলেনিয়ামের প্রথম জেনারেশন যারা একটা কৃষিজমিকে কেন্দ্র করে এরকম একটা বিপ্লব দেখল। ওর ইংরাজীর শিক্ষক বলেছিলেন, ‘উনিশ শ’ সাতচল্লিশের মতোই এও এক ক্ষমতার হস্তান্তর, বিপ্লব ফিপ্লব কিছু নয়’। আজ ষোলোই ফেব্রুয়ারি দুহাজার চোদ্দো। নন্দীগ্রাম গণহত্যার প্রতিবাদে যারা মিছিল করেছিলেন সেদিন, সেই দলের সদস্যরা এখন দুভাগ। প্রথম জনেরা যারা আজীবন সিপিয়েম করে এসেছিলেন, সরকারি গ্রাণ্টও পেতেন, তারা নতুন সরকারের আনুগত্য স্বীকার করতে রাজি হলেন না। আর দ্বিতীয় পক্ষ, যারা কিছুই পেতেন না প্রায় থিয়েটার করে, এমনকি তাদের ভাগের গ্রাণ্টটুকুও সেসময়ের সিনিয়রেরা নিজস্ব ক্ষমতার জোড়ে পেতে দিচ্ছিলেন না, তারা প্রথমে রেলের প্যাসেঞ্জার সার্ভিস কমিটি ও পরে নাট্য অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান বা সদস্য ও তদুপরি দলের টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে কেউ মন্ত্রী কিংবা কেউ সাংসদ হয়েছেন। প্রথম দল অভিযোগ করত দ্বিতীয় দলের এথিক্স নিয়ে। আর দ্বিতীয় দলের তো কোনো এথিক্স প্রথম দলের মতে ছিলই না, তাই তারা সেসবের বিলো দ্য বেল্টই উত্তর দিত। কিন্তু এই থিয়েটার কর্পোরেট থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার নয়। আর কর্পোরেটের প্রথম নিয়মই এই, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা কোনো কিছুই চিরদিনের নয়।
এরকম পরিস্থিতি কৌরবের কাছে নতুন বলেই বোধ হয় ও নিজের প্রতিক্রিয়া ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। ওর মনে আছে মণিপুরে কোরাস রেপার্টরি-তে সে যত না নাটকের বই দেখেছিল, তার চেয়ে বেশি দেখেছিল, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বই। প্রথম প্রথম সে অবাক হলেও পরে বুঝেছে যে একই ভাষার থিয়েটার করলেও পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এই কারণেই মফস্বল ও কলকাতার থিয়েটার বলে একটা বিভাজন রয়ে গেছে। সে বুঝেছে কেন ওরা এখন আঠারোটা স্যালারি গ্রাণ্ট পায়, যেখানে অনেকেই এই বিষয়ে কিছুই জানে না, এবং সঠিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জন্য যে একসময় একটা সঠিক ক্ষমতারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে এটাও বুঝতে বাকি থাকে না ওর। আর তাই থিয়েটার কমিউনিটির পক্ষ থেকে একজন সাংসদ থাকলে সুবিধেই হয় এ কথা বুঝতে পারে। রণিদা বুঝেছে ওর আগে। সুব্রত বোসও তাই। আসলে জীবনের প্রতিটা বাঁকেই রাজনীতি। কৌরব কখনই সংগঠন করার কথা ভাবেনি। এক কারুবাসনা থেকে ওর থিয়েটার করতে আসা। নিজেকে একজন আউটসাইডারই মনে করে সে। ফলে এইসব ঘটনার মধ্যে কেমন একটা দমবন্ধ লাগে তার। সংগঠনের ভিতর ক্রমশ বুঝতে পারে সিঁড়ি কতটা পিচ্ছিল। সময় কতটা শ্যাওলামাখা। সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘুম না হলে ইরিটেশন হয় ওর। গলা শুকিয়ে আসে।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.