আজ থেকে এক দশক আগে, ২০১৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ, লাঞ্চের আমন্ত্রণে মণীশদার (মণীশ মিত্র, কসবা অর্ঘ্য নাট্যদলের নির্দেশক) বাড়িতে আমার প্রথম যাওয়া। কলকাতার প্রফেশনাল নাট্যজগতেও সেই বিকেলেই আমার প্রথম প্রবেশ। যদিও মঞ্চের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নতুন নয়! তবু নিজের যাবতীয় কুণ্ঠা ও টালমাটাল কৈশোর নিয়ে সেদিন মণীশদার সঙ্গে যেটুকু কথা হয়েছিল তাও কেবলই পড়াশোনা বিষয়ক, নাটক বিষয়ক নয়; কাকতালীয়ভাবে সেই আলোচনাকে সঙ্গ দিয়েছিল আমাদের এসইউসিআই ও আশুতোষ কলেজ যোগ। একদশকের এই চলনে রাজনৈতিক, সামাজিক বা নান্দনিক প্রায় সমস্ত দিকেই আজ আমার অবস্থান, তাঁর তথা কলকাতার সামগ্রিক শিল্পীমানুষের সাধারণ ভিড়ের থেকে কিছুটা বিপ্রতীপই বলা চলে। আর তাই বাংলা থিয়েটার বলতে সাধারণভাবে মানুষ আজ যা বোঝেন, সেই সঙ্ঘে, সেই ভ্রাতৃসঙ্ঘে, আজ দশবছর পরেও আমি ঠিক ততটা ‘কমফর্টেবল’ নই। তবু সেইদিনের গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম। কারণ নিজস্ব পড়াশোনা বিষয়ে আমার অহংকার মণীশদার লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রথম আঘাত পায়। অনেক অনেক বই বলে নয়, কিন্তু সেখানে যা বই ছিল, তার মধ্যে কেবল একটি মাত্র বইয়ের (শাহজাদ ফিরদাউসের ব্যাস) পাঠ অভিজ্ঞতা ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই ছিল না। মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্য-এর সঙ্গেও সেই প্রথম আলাপ, এবং এন পি উন্নির নাট্যশাস্ত্রের চারটি খণ্ড। এক কিশোর যে অ্যাকাডেমিক্স-কেই পরম বলে মনে করত, পেটে যার সামগ্রিকতার খিদে, তাঁর স্বপ্ন ও সেকুলারিজমকে এইবার প্রথম আঘাত দেবে বসুধৈব কটুম্বকম বোধ, শিল্পের মধ্যেই যে আসল সামগ্রিকতা, এক নাস্তিক কীভাবে সেই অস্তিত্বের আভাস পাবে, এই সিরিজ সেই অভিজ্ঞতার গল্প। অবশ্যই ব্লগের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই আমরা ধীরে ধীরে খুব সহজ ভাষায় জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব নাট্যশাস্ত্র পাঠের প্রাথমিক ধারণাগুলিকে।
নাট্যশাস্ত্র বলতে আমরা বর্তমানে যে শাস্ত্রটির কথা উল্লেখ করি, তা হল ভরতের নাট্যশাস্ত্র। ভরত কে? ভরত একজন নাট্যাচার্য। এখন ভরত তাঁর নাম নাকি উপাধি সেই নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা আছে। নাট্যশাস্ত্র অর্থাৎ যে শাস্ত্রে নাট্যকলার কথা উল্লেখ আছে? এই কথাটিও আংশিকভাবে সত্য। তাহলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি কী? অবশ্য এই কৌতূহলের আগেও আরও কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। যেমন ভরতের নাট্যশাস্ত্র কেন? তাহলে কী আরও অন্য আচার্যেরও নাট্যশাস্ত্র আছে? আচ্ছা নাট্যশাস্ত্রের স্থান, কাল কী আর পাত্রই বা কারা? ইত্যাদি নানান প্রশ্নের সমাধান আমরা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করব। আর কেন নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন জরুরি, বা নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়নের ফলে আমাদের কী উপকার হবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব সেই দিকটিও। আসলে যেকোনো শাস্ত্র অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি যেটা, তা হল তার অধিকারী হয়ে ওঠা। আমরা ধীরে ধীরে সেই অধিকারী হয়ে ওঠেরই চেষ্টা করব আগামী দিনে এই ব্লগের মাধ্যমে। নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন এই ব্লগের মুল উদ্দেশ নয়, আমাদের এই ব্লগটির সার্থকতা হবে পাঠক অধিকারী হয়ে উঠলে।
নাট্যশাস্ত্র মূলত অনুষ্টুপ ছন্দে (কোনো অংশে উপজাতি ও আর্যা ছন্দও দেখা যায়) এবং কিছুটা গদ্য এবং কিছুটা সূত্রাকারে রচিত, ভারতীয় পার্ফরমনিং আর্টস-এর মূলগ্রন্থ। ভরতমুনি আসলে আত্রেয়াদি অন্যান্য মুনিদের নাট্য বিষয়ক কৌতূহলগুলিকে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন নিবারণ করার এই নাট্যশাস্ত্রের মাধ্যমে। ৩৬টি অধ্যায়ের এই সংকলনে, মুনিরা পাঁচটি প্রধান ও পরে আরও কিছু আনুষঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন ভরতমুনিকে। সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভরত নাট্যের উৎপত্তি ও এই পৃথিবীতে তার প্রয়োগকৌশলসহ নাট্যশালার নির্মাণ, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, প্রাথমিক প্রস্তুতি, নাট্যের কোরিওগ্রাফি, বিভিন্ন অভিনয়, রস, ভাব ইত্যাদির আলোচনা করেছেন। এমনকি অভিনেতা তথা নটের প্রশিক্ষণ সম্বন্ধেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভরত মুনি। আত্রেয়সহ অন্যান্য মুনিদের যে পাঁচটি প্রধান প্রশ্ন ছিল তার মধ্যে দিয়ে তাঁরা জেনে নিতে চেয়ছিলেন সামগ্রিক নাট্যকে। ভরতও তাই প্রায় ৬০০০ টি কারিকা, সূত্র ও গদ্যাংশের র দ্বারা সামগ্রিকভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন নাট্যকে। কারিকা কী? কারিকা হলো সেই সমস্ত শ্লোক বা সংক্ষিপ্ত বাক্য, যা খুব কম শব্দ ব্যবহার করে একটি নিয়ম বা ধারণা সহজভাবে ব্যাখ্যা করে। কারিকার মূল লক্ষ্য হলো নিয়ম বা সংজ্ঞাকে সহজ ও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা, যাতে তা সহজে মনে রাখা যায়। এখন আমরা এই নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করি কাশ্মীর শৈবাগমের অন্যতম গুরু শ্রী অভিনবগুপ্তপদাচার্যের নাট্যশাস্ত্রের উপর টীকা ‘অভিনবভারতী’-র মাধ্যমে। এবং সেই টীকার সূত্র ধরেই জানতে পারি এই ষটসহস্রী নাট্যশাস্ত্র আসলে দ্বাদশসহস্রী নাট্যশাস্ত্রের সংক্ষেপিত রূপ। মানে ভরতের এই নাট্যশাস্ত্র যা কিনা ৬০০০ কারিকা দ্বারা রচিত, তা আসলে ১২০০০ কারিকা দ্বারা রচিত অন্য এক নাট্যশাস্ত্রের সংক্ষেপিতরূপ। তাহলে সেই নাট্যশাস্ত্রটি কে রচনা করেছিলেন?
অমরকোষ (অমরসিংহের রচনা) ও পাণিণি-র অষ্টাধ্যায়ীতে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। অমরকোষে নাট্যের তিনটি পরম্পরার উল্লেখ আছে। প্রথম শিলালির নটসূত্র, দ্বিতীয় কৃশাশ্বের নাট্যশাস্ত্র এবং তৃতীয়ত ভরতের নাট্যশাস্ত্র। পাণিনির মতে শিলালি বিরচিত নটসূত্রের অনুগামীদের শৈলালিন বলা হতো এবং কৃশাশ্ব মতে দীক্ষিতদের বলা হতো কৃশাশ্বিন। বিদ্বানদের মত, এই শিলালিন ও কৃশাশ্বিন বর্তমান যে ভরতের আলোচনা আমরা করছি তার পূর্ববর্তী।
পারাশর্যশিলালিভ্যাং ভিক্ষুনটসূত্রয়োহ্ (অষ্টাধ্যায়ীর ৪.৩.১১০ সূত্র)
খুব ব্যাখ্যা না করে সহজে বোঝাতে হলে পরাশর ভিক্ষুসূত্র রচনা করেছিলেন এবং শিলালি নটসূত্র। ঠিক তার পরের সূত্রেই রয়েছে
কর্মন্দকৃশাশ্বাদিনিহ্ (অষ্টাধ্যায়ীর ৪.৩.১১১ সূত্র)
এর ব্যাখ্যায় এস সি বসু তার টীকায় লিখছেন ‘কর্মন্দিনো ভিক্ষবঃ’ এবং ‘কৃশাশ্বিনো নটাঃ’ কথাদুটি। অর্থাৎ কর্মন্দ” (कर्मन्द) গোষ্ঠীর লোকেরা “ভিক্ষু” (ভিক্ষুক বা সন্ন্যাসী) হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, “কৃশাশ্বিনো নটাঃ” নির্দেশ করে যে “কৃশাশ্ব” (कृशाश्व) গোষ্ঠীর লোকেরা “নট” (অভিনেতা বা পারফর্মার) হিসেবে পরিচিত।
নাট্যশাস্ত্রে কখনো কখনো অভিনেতাদের (নট) শৈলালক বলা হয়, যা শৈলালিন পরম্পরা-র ঐতিহ্য প্রমাণ করে। কিছু বিদ্বানের মতে, শিলালিনের নট-সুত্রগুলি (যা আমনায় (বা আম্নায়) প্রথার অন্তর্ভুক্ত) থেকে ভরত অনুপ্রাণিত হয়ে নাট্যশাস্ত্রের পূর্বরঙ্গ-এর কৌশল ও বিধি রচনা করেছিলেন। ধারণা করা যতেই পারে, শিলালির পরম্পরা সম্ভবত নাট্যের সজ্জা, অভিনয় শৈলী, এবং উপাসনার বিষয়ে বেশ অগ্রগণ্য ছিল। ভরত মুনি সেই সমস্ত প্রাচীন পরম্পরা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই চিন্তাও অমূলক নয়।
অর্থাৎ ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র রচনার আগেই ভারতবর্ষে নাট্যের উপযোগী শাস্ত্র, সূত্র প্রভৃতি ছিল এবং ছিল তদ্ উপযোগী পরম্পরাও। এছাড়া রামায়ণ, মহাভারত এবং শতপথ ব্রাহ্মণ এও নাট্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতে সভাপর্বে ‘শৈলুষ’ (शैलूष) শব্দের প্রয়োগ দেখি, যা একজন অভিনেতা, নর্তক, বা পারফর্মারকে নির্দেশ করে। আমার ব্যক্তিগত দুঃখ এটাই শ্রী রাম ভরতকে বঙ্গোপসাগরের কাছে যে নট সম্প্রদায় (source: https://www.wisdomlib.org/definition/shailusha) এবং সিন্ধুনদের তীরবর্তী যে শৈলুষ গন্ধর্ব ছিলেন (বাল্মীকি রামায়ণ, উত্তর কাণ্ড এবং অগ্নি পুরাণ, অধ্যায় ১১ দ্রষ্টব্য) তাঁদের হত্যা করার ফরমান জানিয়েছিলেন। আবার যেকোনো শিল্পীকে আমরা তাঁরই পুত্রদের নামে কুশীলব বলে চিহ্নিত করি। অবশ্য এটা কোনো শ্লেষ নয়। এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে, সে আলোচনা করার অবকাশ নিশ্চয়ই সামনের দিনে আসবে। আজকের মতন এখানে বিরতি দেওয়াই ভালো; পরের পর্বে আমরা ঠিক এই প্রশ্নগুলির সমাধানে আবার উৎসাহী হব।
‘পুর্ববর্তী’, নাকি পূর্ববর্তী?
Anyway, following. Waiting for next.
পূর্ববর্তী, বানান ভুল হয়েছে।
ei Porashor ki mahabharata er Porashor Muni???
হতে পারে…
karika ebong sutra er modhye ki parthokyo?
কমেন্ট বক্সে খুব সহজে বোঝাতে গেলে, কারিকা পদ্যশৈলিতে রচিত। শ্লোক অনুষ্টুপের একটা বিশেষ প্রকার। কিন্তু সূত্র হচ্ছে ধাঁধার মতন। কারিকার ক্ষুদ্রতম রূপ বলে পারেন। সবচেয়ে কম কথায় বলা যায় যেটা।
বেশি কথায় জানতে গেলে কী করতে হবে?
যেমন যোগসূত্র বা ব্রহ্মসূত্র, কয়েক পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারেন। স্ট্রাকচার বুঝতে পারবেন।