এডিট যার, ডকুমেন্টরি তার (পর্ব ৭) - Rik Amrit

এডিট যার, ডকুমেন্টরি তার (পর্ব ৭)

Listen to this article

Enjoy hands-free reading with our audio player

3 min listen Multiple voices available
Ready to play
Audio Controls
Ready to play
হাতের সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দুজনে বেশ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কৌরবের দ্য ট্রুথ ইস কামিং আউট অফ ওয়েল নামের একটি ছবির কথা মনে পড়ে। সেই ছবিটি একটি লোককথার উপর ভিত্তি করে আঁকা। একবার সত্য এবং মিথ্যা নিজেদের মধ্যে দেখা করে বেশ কিছু বিষয়ে বোঝাপড়া করতে। এবং কথা বলতে বলতে তারা চলে আসে একটা কুয়োর পাশে। মিথ্যা সেই কুয়োর মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে সত্যকে বলে, ‘দেখ, কী পরিষ্কার জল। চল স্নান করি’। এবং অবশ্যই সত্য সে কথা বিশ্বাস করেনি। তাই সে নিজেই কুয়োর মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখলো কুয়োর জল সত্যিই পরিষ্কার। তাই মিথ্যার প্রস্তাবে রাজী হয়ে দুজনে পোশাক ছেড়ে নেমে পড়লো কুয়োয়। কিন্তু স্নানের মাঝপথে মিথ্যা কুয়ো থেকে উঠে এসে সত্যের পোশাক পরে পালিয়ে যায়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিথ্যাকে ফিরতে না দেখে সত্য-র সন্দেহ হয়, ও কুয়ো থেকে উঠে আসে এবং দেখে মিথ্যা তো নেইই, এমনকি তার পোশাকও নেই। রাগে অন্ধ হয়ে সত্য মিথ্যাকে খুঁজতে বের হয় কিন্তু সত্যকে ওভাবে ন্যাংটো দেখে সমাজের সভ্য মানুষেরা চিৎকার করে ওঠে, তেড়ে আসে, ঢিল ছোড়ে। সত্য অনেক চেষ্টার পরে তাদের আসল কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়। তাই রাগে দুঃখে অপমানে ফের কুয়োয় ভিতর লুকিয়ে পরে। এরপর থেকে সত্য কখনও আর কাউকে দেখা দেয়নি। মানুষ দেখেনি তাকে আর বরং যাকে দেখেছে কিংবা দেখে ভেবেছে সত্য, সে আসলে সত্যের পোশাক পরা মিথ্যা। এই ছিল গল্প। ঈশিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে

– স্কুলে পড়ানো সভ্যতার সংকট থেকে আমাদের এবার বেরিয়ে আসা উচিত তাই না?

– কীভাবে? দল ছেড়ে দিয়ে?

– প্রাইমারিলি, মে বি। আমার কাজ অভিনয় করা, আর তুই তো লিখিস। আমি রণিদার সঙ্গে কাজ করব না, এটা আমার বিস্ময়কে মোরাল সাপোর্ট, আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রফেশনাল কমিটমেন্টের কারণে এই শোগুলো করা। রণিদা জানে। ও তো তোরও ছোটবেলার বন্ধু। তুই বরং লেখ না?

– শুধু লিখলেই তো হয় না ঈশিত।

পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে কৌরবকে দেয় ঈশিত।

– অপূর্ব, আমার বন্ধু। কলেজ স্ট্রিটে ওর অফিস আছে। যত্ন নিয়ে কাজটা করে। অসুবিধা হবে না।

দুজনের এই আলোচনা আর বেশি দূর গড়ায় না, কারণ সিদ্ধার্থদা এসে কৌরবকে জানিয়েছে, ‘রণিদা তোকে খুঁজছে’।

বাস থেকে নেমে কৌরব এগিয়ে গেল ঈশিতের দিকে। এবারও  পকেট থেকে সিগারেট বের করে, ঈশিতের কাছ থেকে লাইটার নিয়ে আগুন ধরায়। একটা লম্বা টান। ঈশিত এক মনে চেয়ে আছে, চাঁদের দিকে। সত্যিই এরকম চাঁদ কলকাতায় কোনোদিন ওঠেনি এরকম মনে করাতে কোন অপরাধ নেই বলেই মনে হয় ওর। কৌরব এটা দেখে ঈশিতের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে,

– ‘চাঁদের ওপিঠে’ বইতে একটা একটা জেন গল্প পড়েছিলাম। শুনবি?

– বল

– জেন গুরু রিয়োকান এক নির্জন পাহাড়তলিতে ছোট একটি কুটিরে খুব সরল জীবন যাপন করতেন। তো একদিন তিনি বাড়ি নেই। এমন সময় তার বাড়িতে এক চোর চুরি করতে আসে। কিন্তু চুরি করার মতন কিছু থাকলে তো সে চুরি করবে। সে হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। ততক্ষণে রিয়োকান ফিরে আসেন এবং চোরকে ধরে ফেলেন। এবং তাকে বলেন, ‘তুমি হয়তো অনেকটা পথ হেঁটে আমাকে দেখতে এসেছ তো তোমাকে তোমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুমি এক কাজ করো, তোমাকে দেয়াড় মতন তো আমার কাছে কিছুই নেই, তো তুমি অনুগ্রহ করে আমার এই পোশাকটিই উপহার হিসেবে নাও’। চোর অবাক হয়ে পোশাকটা নিয়ে চলে যায়। রিয়োকান উলঙ্গ বসে রাত্তিরে চাঁদ দেখতে লাগলেন। চোরটাকে তাঁর বেচারা বলে মনে হয়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে অন্যমনে ভাবলেন তিনি, ‘যদি আমি এই অপূর্ব চাঁদটি ওকে দিতে পারতাম’!

দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। বাসের ড্রাইভার ওদের হর্ন দিয়ে ডাকে।

কৌরবের মাথার ভিতর চিন্তাগুলো এতক্ষণ ছিল ঘোড়ার মতন, এই বাসের সঙ্গেই যেন ফরমুলা ওয়ানে অংশগ্রহণ করেছে এমন মনোভাব, এখন তারা স্বধর্মে উট হয়েছে। নাটক শুরুর আগে যেমন একটা টেনশন ও নার্ভাসনেস কাজ করে, আর সেই জন্য অভিনেতা মেকআপ ও পোশাকে নিজের আসলে স্বরূপ ঢেকে ফেলতে চায়, ওর চিন্তারা এতক্ষণ সেই আভরণের আড়ালে ছিল যেন, এখন শো শেষে চরিত্রের আহার্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাইছে।

সে ঈশিতের সঙ্গে প্রথম বাসটায় উঠে এসেছে। বসার আগে অন্ধকারেও সকলকে আরেকবার বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখেছে সে। তাদের মধ্যে অনেকেই বয়সে ওর চেয়ে ছোট, কেউ প্রায় সমান, কেউ বা বড়। এরা প্রত্যেকেই মার্কামারা অভিনেতা বা নাচিয়ে হতে চায়। তার পিছনেই ছোটাছুটি করে মরে। এদের প্রত্যেককে নিয়েই ওর টিম। তবু সকলের মাঝে ঈশিত কেমন আলাদা, ওর পাশে বসেই কৌরব অনুভব করতে পারে ওর ভিতরে শ্মশানের বৈরাগ্য। ঈশিত উচ্চাভিলাষী একথা কৌরব জানে, কিন্তু তার থেকেও বড় ওর দম্ভ, যা ওকে নিজের উচ্চাভিলাষকে লাথি মেরে চলে যাওয়ার দুঃসাহস দেয়। কৌরব জীবনের অতিরিক্ত উৎসাহে থিয়েটার করতে আসে। ফিজিক্স পড়ার সময় তার একমাত্র কাজ ছিল অবজারভেশন, জড়জগতে যা ঘটছে তার পিছনের তত্ত্বকে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করা। থিয়েটার করতে এসে সে মানবজীবনের অনুভূতি আকাঙ্ক্ষা অক্ষমতার সঙ্গে পরিচিত হয়। সেই মায়াকে নিজের মতন করে সাজিয়ে মঞ্চের উপর আরেকটি জগৎ নির্মাণের লোভ তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু সেই উদ্দীপনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। প্রচার, সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার কাছে জীবনের উপেক্ষিত অন্ধত্ব একসময় নতিস্বীকার করে। কাজের থেকে বড় হয়ে ওঠে টেড টক। সৃষ্টির থেকে প্রোডাক্টকে বড় বলে মনে হয়। প্রকৃতির থেকে বড় হয়ে ওঠেন ডাক্তার। এক অন্যরকম দ্বিধা হয় কৌরবের। ম্যাকবেথ এই পৃথিবীর অন্যতম এক উৎকৃষ্ট সৃজন, কিন্তু সেও তো আসলে একটি মোল্ডেড ফ্যাক্ট একথা মনে পড়ে। সাংবাদিকের কাছে তা চিন্তার বিষয় হলেও, একজন নাটুয়ার এই নিয়ে ভয় পাওয়ার কথা নয়। নাটকের মূল আধারই তো মিথ্যা। শেক্সপীয়র এই জগৎকে রঙ্গমঞ্চ বলার সময় এই কথাটি মাথায় রেখেছিলেন কি! পেঁয়াজের আঁশের মতন এই চিন্তারা, তাদেরই খোলস ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। সন্দেহ হয় নিজের উচ্চাভিলাষ, ডিক্টেটরশিপের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারা ক্ষমতার উপর। বাসের ভিতরে অন্ধকার, সেই অন্ধকারে আধো ঘুমে আধো জাগরণে রয়েছে ওর টিম, সৈন্যদল। মাত্র কয়েকঘন্টা আগেই রণিদা ওকে প্রস্তাব দিয়েছেন তাদের লেফটেন্যান্ট হওয়ার।

Disclaimer

This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.

Comments (0)

Rate this Article

0.0 (0 ratings)
How do you feel about this article?
Comments (0)
💬

No comments yet

Be the first to share your thoughts!

Join the Discussion
0/1000 characters
Page-Specific Footer Example