১০
ঘরের ছোট জানলাটিকে এক রাক্ষসের বড়ো মুখ বলে মনে হয়। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে গল্প শোনার স্মৃতি থেকে উঠে আসা। সেখানে বড় রাজপথ, উঁচু ফ্ল্যাট। গত রাত্তিরে একটা ট্রাক এসে সিগন্যাল পোস্টে ধাক্কা মেরেছে। এখন পুলিশের হাতে জাদুদণ্ড। হলদেসবুজলাল। জরুরি অবস্থা বহাল।
আমার প্রথম আসাতেই কান্না। এখন তাই কোনো কিছুকেই আশ্চর্য মনে হয় না। আজ ট্রেনে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল যে লোকটা তাঁর দিকে একটু জল বাড়িয়ে দেওয়ার আগে নিজের গলা ভিজিয়ে নিয়েছিল সামনের সিটে বসে থাকা আরেকটা লোক, আমি তার দিকে কেবল তাকিয়েই ছিলাম। আর কিছু করিনি।
আগামী তবে কার?
মালিক আমাকে টাঙা দিয়ে গেছে। অদূরে ও আমার বিষণ্ণতা কি ?
৯
আমি সেই পিতৃহীন সন্তান, যে আজও আশা করে বাবা বাড়ি এলে ঘুড়ি কেনা হবে ঠিকই। এই একটা স্বপ্নই তো বারবার হারিয়ে যাওয়া থেকে আমাকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনে। এই ভাবেই যতক্ষণ পারো স্পর্শ করে থাকো।
ট্রেন তার নিজস্ব ভাড়ায় নিজস্ব গতিতে আমাকে আমার লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছে। একটা বন্ধুর সাথে দেখা করতে চলেছি। অনেক দূরের…
বাস ভাড়া দিয়ে দূরত্ব মাপা ঠিক নয় বোধ হয় !
দ্বিধায় জীবন।
৮
থমকে গেলাম সিগনালে। সমস্যা গভীর হয়ে উঠল তাড়াহুড়োয়। এখান থেকে একটু অন্ধকার হবে পথ !
তবু এত কোলাহল তো সেই একটুখানি নিস্তব্ধতাকে ঢেকে রাখার জন্যই…
৭
শেষমেশ যখন পৌঁছোলাম তখন রাত্তির হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ পর এই প্রথম আড়মোড়া ভাঙলাম। শহরটা যেন সাপের শরীর। এখন প্রবল গ্রীষ্ম। তাও। মেয়েরা এখানে দেশের অন্য প্রান্তের তুলনায় সুরক্ষিত। গত কয়েকমাসে আমি খবরের কাগজে গুনে গুনে কেবল ১৪টি রেপের ঘটনা পেয়েছি। রেজওয়ানা তাই নিজেই এসেছে আমাকে নিতে। রেজওয়ানা, আমার বন্ধু।
রেজওয়ানার সাথে আমার বন্ধুত্বের ৭ বছর কেটে গেছে। আইন্সটাইনের থিয়োরি অনুযায়ী এটা তাই আর ভাঙ্গার নয়। দেখা হওয়ার সাথেই সাথেই ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল বাড়ি কেমন আছে? শহর কেমন আছে আমার। চোখের সামনে আরেকবার রাক্ষসের সেই বড় মুখটা ভেসে উঠল। বললাম ‘কোমায়’।
ও বলল ‘এখানের রোদ্দুরেও একটু ধুলো পড়েছে। শহরটা তাই কেমন একটা ঠাণ্ডা। নইলে এখানেও মিটিং মিছিল চলতেই থাকে।’
আমার সাথে রেজওয়ানার একটা মিল আছে। আমরা দুজনেই ভাস্করদার ওই কথাটাকে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য করে ফেলেছি। ‘ দশদিক বন্ধ হলে নতুন একটা দিক খুলে দিয়ে যাব আমি’। সেই একটা দিক খুঁজতে খুঁজতে রেজওয়ানা এই অঞ্চলে এসে পড়েছে, আর আমি ছিটকে গেছি অন্য প্রান্তে। মাঝে মাঝে একবার করে এসে ওর সাথে দেখা করে যাই। আসতে আমার ভালোই লাগে। ও হ্যাঁ ভাস্করদা একজন কবি। আমার নাম অনির্বাণ।
আর রেজওয়ানার সাথে আমার কোনোদিনই সেক্স হয়নি। এই একশকুড়িকোটির দেশে সেক্স নিয়ে আর কোনো কৌতুহল থাকার কথা তো নয় !
৬
পথ একমুখী । আমি যতবারই গেছি ওখানে কেবল আমি জানি আর ফিরে আসিনি। এবারেও দুই দিনেরই জার্নি ছিল। মহাকাল কি আর ঘড়ির নিয়মে চলে!
মহাকাল তো ঘড়ির নিয়মে চলে না। তাই চিমনির দিকে গড়িয়ে যাওয়ার আগে উপেক্ষার কাছে নিজের ভার্চু জমা রেখে যেতে চাই…
৫
গতবার ও এবারের আসা যাওয়ার মাঝে অনেকগুলো সময় কেটে গেছে। বোধ হয় দশদিকের ঠোক্কর খেতে খেতে যতক্ষণে জানতে পারা যায় যে এই দশটা দিক আদতেই বন্ধ আছে এবং থাকবেও, তখন নতুন একটা দিকের সন্ধান করার শক্তি বা সামর্থ্য বা সদিচ্ছা কোনোটাই বাকি থাকে না। তখন যে সম্ভাবনা পড়ে থাকে সেটা কেবলই স্কুলের স্টাফরুমে বসে বাকি কলিগদের পিছনে কাঠি করা, ক্লাসে গিয়ে নিজের টুইশন সেন্টারের প্রমোশন আর সময়ের এই অনুব্রতকালে সেটা জোটাও যখন অসম্ভবসম, তখন অন্যের দোকানে মাল সাপ্লাই করা। টিকে থাকা সত্যিই খুব চাপের। বেঁচে যাওয়ার লড়াইতে কাস্টেড অ্যাওয়ে। তবু যদি মনে করা যায় যে এই এগারো নম্বর দিকটার সম্বন্ধে জানার পথটা আগের দশটা দিক হয়েই আসে, তবু মনে সন্দেহ জাগে এইটাও বন্ধ হবে না তো! আসলে জাত-মধ্যবিত্ত মন। নিশ্চয়তা খোঁজে সবসময়। তাই কি? সাপের মত চলাটা মনে হয় খুব সহজ। মেরুদণ্ডের বোঝাটা তো থাকে না। না তো সাপেরও তো মেরুদণ্ড থাকে। ফ্লেক্সিব্ল। এই ফ্লেক্সিব্ল মেরুদণ্ড হইতে সাবধান।
নিজের মধ্যে নিজে ডুবে থাকাটাও শ্বাসরোধকারী… সেখান থেকেই আগামী পূজোর কাঠামো তুলে আনো।
৪
আপনারা যারা অনির্বাণকে এতক্ষণ পুরুষ বলে ভেবেছেন তাদের জানিয়ে দি’, সে একজন নারী। আর রেজওয়ানাকে যারা নারী বলে ভেবেছেন, ও কিন্তু আসলে পুরুষ। চমকে গেলেন? মনে হচ্ছে আমি ভাঁট বকছি? বেশ। গল্পটা কিন্তু আমার, তাই এখানে আমিই ভগবান। আর আপনি হ্যাঁ আপনাকেই বলছি পাঠক, আপনি কি জানেন না যে জেণ্ডার ইস অ্যা ফ্লুইড থিং?
ওহ্, তাহলে ওই রেপের জায়গাটা ?
“ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন”।
৩
-তুমি খুশি রেজওয়ানা? জীবনকে এইভাবে পেয়ে!
– আমি দায়বদ্ধ।
রাত্তিরে খাওয়ার পর আমরা একসাথে একটু হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। গোটা শহরটা সবে ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়ার প্ল্যান করছে।
– কার কাছে?
– যিনি এই গল্পটা লিখছেন, তাঁর কাছে।
– তোমার নিজের কোনো চাহিদা নেই?
– তোমার?
– আমার আছে বলেই তো আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসি। প্রতিবার উপার্জন থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে উপহার আনি তোমার জন্য। আমাদের যাপন, আমাদের বাঁচতে চাওয়ার ধরণ দুজনকে পরস্পরের থেকে দূরে রেখেছে। এই পৃথিবীতে সময় এখনও দূরত্বের একক হয়ে ওঠেনি, কোনোদিন উঠবেও না। নইলে আমাদের মধ্যিখানে এই এত ট্রেন বাসের ঝক্কি থাকত না। এক লক্ষ্য নিয়েও আলাদা আলাদা হত না পথ আমাদের। একসাথে কাটানো মুহুর্তগুলো দিয়েই আমরা আমাদের কাছে আসা নির্মাণ করতাম।
– তবু তুমি জানো না আজ রাত্তিরে তোমার অবদমিতরা আমার হবে কিনা। তুমি জানো না কেন তোমাকে এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিক বানানো হবে যেখানে ধর্ম নির্ধারণ করে বিবাহের অ্যাক্ট। নাকি এই জার্নি করে আসা, দেখা হওয়া এবং রাত্তিরের খাওয়ার মধ্যে তার পরিসমাপ্তি হবে। তুমি কি নতুন একটা দিক খুঁজে পাবে? সবটাই তো নির্ধারণ করছে ওই বেজন্মা লেখকটা।
– লেখক। অর্থাৎ যিনি আমাদের এই কাহিনীটা লিখছেন, সময়ের রিলেটিভ মোশনে আমাদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। তাই আমাদের বর্তমান তাঁর কাছে অতীত। তিনি তাঁর অতীত দিয়ে আমাদের বর্তমান নির্মাণ করছেন। পরিণতি তো আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তাতে তারও কোনো হাত নেই। তুমি আর আমি কেবল সেই যাত্রাপথের যাত্রীদের প্রতীকমাত্র। গল্পের চরিত্র। তিনি ভাবছেন, তিনি আমাদের ঈশ্বর, আর তাঁর ঈশ্বর তাঁর এই ভাবনাতে মুচকি মুচকি হাসছেন।
– অনির্বাণ !
২
দশদিক আসলে বন্ধই। নতুন একটা দিক আমাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব কারণ আমরা এই দশদিকের গণ্ডির মধ্যেই বন্দি। রেজওয়ানা এই কথাটা বুঝতে পারে না কারণ ও এই গল্পের একজন ইনসাইডার। আমি একজন আউটসাইডার হয়েও সেই নতুন দিকের সন্ধান করতে অপারগ। অনেকটা পথ জার্নি করতে হয়েছে আমাকে এই গল্পে ঢুকতে। আমি কেবল এই গল্পের একজন ইনসাইডার হিসেবে বিহেভ করি। আমার কিছু করার নেই এছাড়া। আমি জানি একমাত্র যিনি এই দশদিকের বন্ধন থেকে মুক্ত তিনি জানেন নতুন দিকের হদিশ। যেখানে ‘আওয়াজ নেই কথা নেই, তবু আশ্চর্য নীরব ফুলে ভরে যাচ্ছে প্রাণের বাগান ‘। আমাদের বাগান। অথচ তাঁর বাগানের খোঁজে তিনিও আমার মতনই একজন অসহায় আউটসাইডার।
আমি জানিনা কীভাবে আমি এই গল্পের মধ্যে প্রবেশ করেছি। আমরা কেউই জানি না কীভাবে আমরা সব্বাই একেকটা গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছি। আমাদের সক্কলের গায়েই একটা করেই টাইম বম্ব বাঁধা। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এই গল্প থেকে নিষ্ক্রমণের।
১
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সার উপর ভয়ে সেঁটিয়ে আছি। অনির্বাণের সাথে দেখা করতে এসেছি ওর বাড়িতে। কিন্তু যেই নামতে যাচ্ছি একটা সাপ এসে আমাকে ছোবল মারতে চাইছে। বারবার। আমি রিক্সায় ভয়ে চড়ে গেলে আবার সাপটাকে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। রিক্সাওলাকে নয় কেবল আমাকে ছোবল মারতেই বারবার তেড়ে আসছে। আমি অনির্বাণ অনির্বাণ করে বার কয়েক চিৎকারও করেছি। নেই কোথাও। আমি প্রে করছি ঈশ্বরের কাছে আমাকে বাঁচানোর জন্য। একসময় হঠাৎ করেই রিক্সাওলা আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে, হারিয়ে গেল। আমি ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। গলা শুকিয়ে গেছে। জলের জন্য স্টুলের দিকে হাত বাড়িয়েছি দেখলাম চেয়ারে অনির্বাণ বসে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। একবার খালি ‘ কি? মিঃ লেখক’ বলে যেন ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিল আমাকে। আমি দেখলাম আমার বুকে ঘড়ির মত একটা কি লাগানো! টাইম বম্ব? অনির্বাণ উঠে দাঁড়াল। আমি স্তম্ভিতের ন্যায় চেয়ে আছি। সময় নেই জেনেই বোধ হয় সময় জানার ইচ্ছেটাকে প্রশমিত করলাম। দেখছি অনির্বাণ দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, আমি গুনছি ১০, ৯,৮,৭…
০
বুম !!!