ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যায় কৌরবের। কিছুক্ষণ ধাতস্থ হতে সময় লাগে। অল্প অল্প ঘাম জমেছে কপালে, চোখের তলায়, নাকের দুপাশে। জামার ভিতরটাও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বুঝতে পারে। জ্যাকেটের চেনটা গলা থেকে নামিয়ে ফেলে। চলে যাওয়া শীত বিপজ্জনক, সর্দি দিয়ে যায়। কৌরবের এসবে কোনোদিনই তেমন হুঁশ নেই, ফলত অসুস্থও হয়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে, দেড়টা। ওরা রওনা হয়েছিল একটা বাজার কিছু আগে। বেশিক্ষণ হয়নি অর্থাৎ। হোয়াটস অ্যাপে অসংখ্য আনরিড মেসেজ। পড়ে দেখার ইচ্ছে হলো না আর। হাই তোলে। মোবাইল বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে রেখে ব্যাকপ্যাক থেকে জলের বোতল বের করে, দু’ঢোক জল খেল। জানলা বন্ধই। কাচের উপর জলীয়বাষ্প। পকেট থেকে মোবাইলটা আবার বের করে নোটবুকে স্বপ্নটার ব্যাপারে যতটা মনে পড়ে, লিখল। সামনের সিটের পাঁচজন এখনও জেগে, নিজেদের মধ্যেই গল্পগুজব করছে, কখনও উত্তেজিত কখনওবা ফিসফিসিয়ে।
কৌরব মনে মনে একটা হিসেব কষতে থাকে। সেই জানুয়ারি মাসের তিন তারিখ জার্নি শুরু হয়েছিল। পাঁচ তারিখ দিল্লীর ভারত রঙ্গ মহোৎসবে শো করে ওরা। সাত তারিখ বিকেলে পূর্বা এক্সপ্রেসে করে, হাওড়া ফিরে আসার কথা, কিন্তু কুয়াশার কারণে ট্রেন দশ ঘণ্টার উপর লেট করে। স্টেশন পৌঁছালো যখন, তখন রাত্তির তিনটে পেড়িয়ে গেছে। সেই অবস্থায় কোনোওমতে একটা ছোটা হাতি গাড়ি ভাড়া করে, গ্রুপে পৌঁছে, সকাল ছটায় আবার একটি স্করপিওতে বেড়িয়ে পড়ে কয়েকজন মিলে বিষ্ণুপুর; সেখানে অন্য একটি নাটকের শো করে আবার গ্রুপে ফেরে ভোর চারটের সময়। সেদিন কলকাতায় শো। পরেরদিন সকালে ফ্লাইটে করে গৌহাটি, সেখান থেকে ফিরে শো মালদায়। মালদা থেকে ওই একই লাগেজ নিয়ে ওরা ফিরে আসে হাওড়া, স্টেশনে ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করে নাগপুরের জন্য ট্রেন। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস। তারপর পুনে, ভুবনেশ্বর, হায়দ্রাবাদ, পাটনা ইত্যাদি করে এরকম স্কেডিউলে আজ ফেব্রুয়ারির ষোলো দুহাজার চোদ্দ। গতকাল পনেরোই ফেব্রুয়ারি শনিবার, ওরা শো করেছে ব্যাঙ্গালোরের রবীন্দ্র কলাক্ষেত্র মঞ্চে। আজই বিকেল ছ’টা থেকে মাইসোর অর্থাৎ মহীশূরের রঙ্গায়নাতে এই একই নাটকের শো। এটাই ওদের এই সিজনের শেষ বাইরের পার্ফরমেন্স। দলের সকলের কাছেই এরকম ট্রাভেল এক্সপিরিয়েন্স প্রথম। বাড়ির জন্য একটা টান সব্বার মনেই। নিজস্ব বিছানা, নিজস্ব স্নানঘর এবং নিজের খাওয়ার টেবিলে বাড়ির রান্না! ওদের এই ভয়েজার প্রবাসী মন, জিভ ও সমস্ত শরীর তিনটেই প্রত্যাশিত আলস্যের জন্য হাপিত্যেস করে বসে আছে।
কৌরব কোনোদিনই খুব বেশি ঘুরকুনো নয়। বাড়িতে তেমন একটা মনও টেকে না ওর, যদি না কোনো একটা লেখাতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন আবার নিজের ঘর ছেড়ে বেরোতেই চায় না। সকলেই জানে যে সে বাড়ির বিষয়ে উন্নাসিক। অথচ দিদাকে, ও পরলোকগত দাদুকে যথেষ্টই ভালোবাসে সে। মা ও বাবা দুজনেই চাকুরিজীবি। তাই ছোট থেকেই সে দিদা-দাদুর কাছে মানুষ। মা ও বাবাকে আত্মীয়র মতো মনে হয়।
প্রাইমারি স্কুলের পর যখন ওর ক্লাস ফাইভ হবে, তখন একবার ওর বাবা, ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেও, কৌরব নিজের বাবাকেই ‘দিতরাষ্ট’ বলে গালি দিয়ে এমন কান্নাকাটি শুরু করে, যে দিদা শেষমেশ আর থাকতে পারেননি। দাদু বুঝিয়েছিলেন, যে সন্তানের উপর দিদার চেয়ে বাবার দাবি কতখানি বেশি, কিন্তু শেষমেশ ওর বাবাও আর ছেলের জেদ থামাতে পারেননি। এর জন্য মা-কে নিজের শ্বশুর-শ্বাশুরি-ননদ-জা সকলের কাছেই কমবেশি খোঁটা শুনতে হয়েছিল, কিন্তু সেসবে খুব বেশি কান সেই ভদ্রমহিলা পাতেননি বলেই এই দাদু-দিদার প্রতিবেশীরা অন্তত মনে করে। তারা ব্যাপারটাকে ভালো ভাবেই মেনে নিয়েছিল, এই নিয়ে খুব বেশি গসিপ কেউ করেনি। কৌরবের মা প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে চার-পাঁচদিন ছেলের সঙ্গে এসে থাকত, বিকেলে কয়েক ঘণ্টা, নিজের স্কুল ছুটির পর। সল্টলেক থেকে বরানগর, আবার সেখান থেকে রুবি, স্বামীর ঠিকানায়।
জানলার বাইরে আনমনে তাকিয়ে ছিল কৌরব। স্বপ্নটাকেই কি ইন্টারপ্রেট করার কথা ভাবছিল! কে জানে? কিছুদিন আগে একটা নাটক দেখেছিল কেরলের ইটফোকে। ‘সি শার্প সি ব্লান্ট’। ডিরেক্টর সোফিয়া স্টেপ। একজন লাইভ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে এম. ডি. পল্লভি এমন একটা পার্ফরমেন্স উপহার দেন দর্শকদের যে থমকে যেতে হয়। শিল্পা নামের একটি মোবাইল অ্যাপের গল্প। সেই অ্যাপের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া একটা মেয়ে, ও ক্রমশ পুরুষশাষিত ইতররতির মধ্যে দিন দিন মানুষ থেকে কনজিউমার হয়ে যাওয়া একটি সভ্যতার আতঙ্কের কথা বলে নাটকটি। এতটাই আতঙ্ক যে যখন উন্নততর ভার্সনে পৌঁছে অ্যাপটির হয়ে পল্লভি সমস্ত দর্শকদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস আমার কাছে স্টোর করা আছে’, তখন হল ভর্তি লোক নিজের ওয়ালেটে হাত দেন। খুব অস্বস্তিতে কেটেছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা নাটকটি দেখার পর। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যতটা লেগেছিল, তার চেয়ে বেশি লেগেছিল ওর আর্টিস্টিক ইগোতে। এরকম কাজের কথা ও কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। ক্রমশ নিজের কাজের প্রতি সন্দেহ হতে থাকে, ও যা করছে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, তার গুরুত্ব নিয়ে। গোটা কলকাতাকেই, কলকাতার সামগ্রিক আর্টিস্টিক এপ্রোচকে একটা বৃহত্তর অথচ মফস্বলীয় বলে মনে হয় ওর।এই নাটকটা পরে আরও দুইবার দেখে দিল্লীর মেটাতে ও কলকাতায় গ্যেটে ইন্সটিউটে। প্রত্যেকবারই একই অনুভব হয়। সেই নাটকটার কথা ভাবছিল কি? ওরকম একটা স্ক্রিপ্ট লেখার সাধ ওর মনে বেশ কয়েকদিন ধরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু কৌরব এখনও জীবনের আসল স্ট্রাগলটার সঙ্গে পরিচিত হয়নি। ওরকম একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে গেলে যে হাহাকার দরকার তা কৌরবের এখনও নেই। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে এখনও সাক্ষাৎ হতে ঢের দেরি। রণিদার সঙ্গে এই নাটকটা বিস্তর আলোচনা হয়েছিল একদিন। খালি ছটফট করছিল, আর বলছিল, ‘আমার দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি এখনও উদাসীন! আমি এখনও এই সময়কে চিনে উঠতে পারিনি। আমি জানিনা আমার কী লেখা উচিত। যে জিনিসটা রোজ আমার সঙ্গে ঘটছে সেটা আমি কেন স্টেজে একটা অভিনয় দেখে জানব!’ রণিদা বাইরে গম্ভীর হয়ে শুনছিলেন ঠিক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওনার কষ্ট নয়, একটা আনন্দই হচ্ছিল কৌরবের জন্যে। আরও ভাবছিলেন নাটকটার সার্থকতার কথা। সত্যিই সেটা শিল্প হয়ে উঠতে পেরেছে। কৌরবকে খালি সামনে থেকে একটা উত্তরই দিয়েছিলেন তিনি, ‘শুধু থেকে যা, তোর ভাষা আর তোর মাধ্যম তোকে দিয়ে তোর কাজ করিয়ে নেবে’। কৌরব কথাটার মানে বোঝেনি, সে এখনও শুধু কল্পনা করে, কল্পনার ভিতরে তলিয়ে যায়। জানলা দিয়ে চোরা হাওয়া আসতে থাকে। মোদী হাওয়া!
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.