যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই ভারতীয় নাট্য পরম্পরার কথা উল্লেখ করেছি, তাই আমার মনে হয় এখন নাট্যশাস্ত্রের ব্যাখ্যা তথা টীকা রচনার যে পরম্পরা তারও একটা আলোচনার প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই আমরা বেশ কয়েকবার অভিনবগুপ্তের কথা উল্লেখ করেছি। আমরা জেনেছি তাঁর রচিত টীকা অভিনবভারতী তথা নাট্যবেদবিবৃতি-র কথা। পরবর্তী পর্বগুলিতে ক্রমে ক্রমে আমরা নাট্যশাস্ত্রের প্রকাশনার ইতিহাস, নাট্যশাস্ত্রের প্রেক্ষাপট ও নাটোৎপত্তি বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিতে পারি। নাট্যোৎপত্তি আমাদের ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরার প্রতি উৎসাহী করে তুলতে পারে। তবে নাট্যশাস্ত্রের অনুবন্ধ চতুষ্টয় অর্থাৎ বিষয় সম্বন্ধ প্রয়োজন ও অধিকারী এই আলোচনার পর আমরা আপাতত একটু বিরতি নেবো। ইতিমধ্যেই আমরা যা যা আলোচনা করেছি, তার যথেষ্ট বিস্তারের প্রয়োজন আছে। কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর দেওয়াও দরকার। তাছাড়া আগ্রহী পাঠকের জন্য তো কমেন্ট বক্স খোলা রইলই, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব কৌতূহল নিরসনের।
সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থে শার্ঙ্গদেব ভট্টলোল্লট, ভট্টউদ্ভট, শ্রী শঙ্কুক, শ্রীমৎকীর্তিধর এবং ভট্টঅভিনবগুপ্তপদাচার্যের কথা উল্লেখ করেছেন। দুঃখের বিষয় একমাত্র অভিনবভারতী ছাড়া আর কোনো টীকা আজ উপলব্ধ আছে বলে আমার জানা নেই। আমার সেই পুরনো লাইব্রেরিগুলির কথা মনে পড়ে নিয়ত। অহিংসা ও শান্তিরক্ষা যে দুটি এক বিষয় নয় এই ভাবনা দৃঢ় হয়। সঙ্গীতরত্নাকর ছাড়াও অভিনবভারতী থেকে আমরা অভিনবগুপ্তের গুরু ভট্টতোত, মাতৃগুপ্ত, ভট্টনায়ক, শাকলীগর্ভ, শ্রী হর্ষ প্রমুখের উল্লেখ পাই। শারদাতনয়ের ভাবপ্রকাশন গ্রন্থ থেকে উল্লেখ পাই সুবন্ধু-র। সাগরনন্দী রচিত নাটকলক্ষণরত্নকোষও তথ্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপুর্ণ উৎস।
নাট্যশাস্ত্রের বার্তিক রচনায় কাশ্মীরের স্থান অগ্রগণ্য। অবশ্য ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির পথ প্রদর্শক হিসেবে কাশ্মীর সবসময়ই এই দেশরূপ যে দেহ তার মাথার মতই কাজ করেছে। ভট্ট উদ্ভট, মাতৃগুপ্ত, শ্রীহর্ষ, ভট্টলোল্লট, শ্রীশঙ্কুক, ভট্টনায়ক, ভট্টতোত এবং অবশ্যই আচার্য অভিনবগুপ্ত এঁরা সকলেই কাশ্মীরের অবদান। এঁদের মধ্যে বার্তিককার শ্রীহর্ষ নৃত্য ও নাট্য এই দুটিকে আলাদা চোখে দেখতে নিমরাজি ছিলেন; তাঁর মতে নৃত্য ও নাট্যের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই; অথচ ব্রিটিশদের চিন্তনের উত্তরাধিকারবহন করে আমরা রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার, আজও নৃত্য বড় না নাট্য বড় সেই তর্কে মশগুল হয়ে আছি। নৈয়ায়িক শ্রীশঙ্কুক রস ও ভাবের চর্চায় তাঁর অনুমিতিবাদের জন্য বিখ্যাত। ভট্টনায়ক রচিত টীকার নাম সহৃদয়দর্পণ। রসসূত্রের যে চারজন প্রমুখ ব্যাখ্যাকারকে আমরা আজ জানি, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
প্রায় ছ’শো বছর ধরে অবিচ্ছিন্ন যে বিভিন্ন ধারায় নাট্যশাস্ত্রের চর্চা কাশ্মীরে হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরু ভট্টতোতের পরম্পরা। অনেকের ধারণা ‘কাব্যকৌতুক’ শ্রীভট্টতত রচিত নাট্যশাস্ত্রের টীকা, কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই। রসের ব্যাখ্যা কেউ সাংখ্য মতে, কেউ বা উৎপত্তিবাদ দিয়ে আবার কেউ ন্যায়ের চর্চায় করেছেন; ভট্টতোত রসকে ব্যাখ্যা করেছেন অলৌকিক হিসেবে। তাঁর মতে রসই নাট্য, সে নাট্যই বেদ। গুরু ভট্টতোতের কথা অনুযায়ী নাট্যে কবি, নট ও প্রেক্ষকের অনুভবে কোনো ভিন্নতা নেই। তিনি পুর্ববর্তী সকলের রস সম্পর্কিত আলোচনাকে খণ্ডন করেন। অভিনগুপ্ত তাঁর ধ্বন্যালোকের টীকা ‘লোচন’-এ লিখেছেন শান্তরস মোক্ষফলদায়ক হওয়ায় তাঁর উপাধ্যায় ভট্টতোত শান্তরসকে পরমপুরুষার্থনিষ্ঠ তথা প্রধান বলে স্বীকার করেছেন। নাট্যশাস্ত্রের উপাধ্যায় ভট্টতোতের কাছ থেকেই আচার্য অভিনবগুপ্ত নাট্যশাস্ত্রের তথা সাহিত্যশাস্ত্র পাঠ সম্পূর্ণ করেন।
এই যে ছ’শো বছরের নিরন্তর সাহিত্যশাস্ত্র ও নাট্যবেদের চর্চা তাঁকে প্রায় সম্পুর্ণ করেন শিবসমান কান্তিমান পিতা নরসিংহগুপ্ত ও মাতা বিদূষী বিমলা-র যোগিনীভূঃ সন্তান মাহেশ্বর, ভবিষ্যতে যিনি বিখ্যাত হবেন গুরুপ্রদত্ত অভিনবগুপ্ত নামে। বিশিষ্টজনে তাঁকে শেষনাগের অবতার হিসেবে মানে। ব্যাকরণ, শৈবদর্শন, যোগশাস্ত্র, তন্ত্র, ব্রহ্মবিদ্যা, কাব্যশাস্ত্র, নাট্যশাস্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তি প্রমাণিত।
অভিনবগুপ্ত রচিত সমস্ত রচনাকে চারটি বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে –
১। তন্ত্রসাহিত্য
২। স্তোত্রসাহিত্য
৩। প্রত্যভিজ্ঞাশাস্ত্র
৪। কাব্যশাস্ত্র ও নাট্যশাস্ত্র
তন্ত্রসাহিত্যের মধ্যে তন্ত্রালোক ও তন্ত্রালোকসার, মালিনীবিজয়বার্তিক, পরাত্রিংশিকাবিবরণ ইত্যাদি বিখ্যাত। দ্বিতীয় বিভাগে ভৈরবস্তত্র ইত্যাদি, তৃতীয় বিভাগে ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞাবিমর্শিনী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। চতুর্থ ভাগে, আনন্দবর্ধন রচিত ধ্বন্যালোকের টীকা লোচন, এবং নাট্যশাস্ত্রের টীকা অভিনবভারতী তথা নাট্যবেদবিবৃতি অন্যতম।
অভিনবভারতী, আজ নাট্যশাস্ত্রের উপর যতগুলি টীকা লেখা হয়েছে, তাঁর মধ্যে একমাত্র যা প্রাপ্তব্য একথা আগেই উল্লেখ করেছি এবং এই টীকাটির মাধ্যমেই আমরা পূর্ববর্তী বহু আচার্যের টীকা তথা নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কিত মত সম্বন্ধে জানতে পারি। অভিনবগুপ্ত রসকে গুরুপরম্পরায় অলৌকিক তথা নাট্যকে অলৌকিকরসাত্মক বস্তু বলে উল্লেখ করেছেন। এই অভিনবগুপ্তপদাচার্য ছাড়া ভারতবর্ষের দর্শনচর্চা অসম্পূর্ণ, অন্ধকার ভারতীয় নাট্য পরম্পরার উজ্জ্বল ইতিহাস। তিনিই ভারতীয় মার্গ নাট্য পরম্পরাকে পুনর্বার অধ্যয়ন করা ও তাঁর পুনর্নির্মাণের মূল অনুপ্রেরণা।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
আমি খুব সচেতনভাবেই এই ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে সময়ের উল্লেখ করছি না, কারণ সময়ের এই গণনা নিয়ে এতদিনের যে ইতিহাস চর্চা তাঁর প্রতি আমার নিজেরই বেশ কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে। তবে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে সময় নিরূপণ নিয়ে কাজ করার। আপাতত পাঠকের প্রতি আমার অনুরোধ এই আলোচনাগুলি থেকে গল্পপাঠের আনন্দ নেওয়ার।
এই সম্পূর্ণ আলোচনায় এখনও আমরা কোনো বাঙালি টীকাকারের উল্লেখ পেলাম না, এ বড় অন্যায়ের বিষয়। সেই অন্যায়ের শাস্তি হতে ‘ভরতবার্তিক’-এর রচয়িতা তৎকালীন তাম্রলিপ্তি তথা বর্তমান তমলুকের বৌদ্ধাচার্য রাহুল আমাকে ক্ষমা করবেন এ প্রার্থনা করি।