আমার বৈশাখের রঙ অমলতাস হলুদ। পঁচিশে বৈশাখ চোদ্দতম পার্বণ শৈশবজুড়ে। স্মৃতির অ্যালবামের পাতা ওল্টালে দেখি এক মুগ্ধ কিশোর, সকাল থেকে ব্যস্ত ফুল কুড়োতে, ঘর গোছাতে। সে আজ সকাল সকাল স্নান করবে, সে আজ আর কোনো অনিয়ম করবে না। বকাও খাবে না কোনো। পিছনের দিকে তাকালে দেখি এই, উৎসবে মানুষের ভিতর কোনো আলস্য নেই, নেই কোনো অকারণ বৈপ্লবিক মনোভাব। যে কিশোরের কথা বলছি এখানে, তাঁর জীবনে ঠাকুর শব্দটির আর কোনো সমার্থক শব্দ নেই তখনও। রামকৃষ্ণকে যেভাবে চিনেছে, রবীন্দ্রনাথকেও জেনেছে সে ঠিক একইভাবে। কুশারী ও ঠাকুরের জটিলতাও যে তাঁর জীবনে আসবে, শৈশবের এই দেবতাকে উপেক্ষা করে একদিন সে-ই খুঁজে নিতে চাইবে আত্মপরিচয়, বাঙালির চিরকালীন সন্দেহ ও হিংসা তাঁকেও স্পর্শ করবে এই সম্ভাবনা অজানা তখন। আজ জীবন এসে গেছে তার, কুড়িটি বছরের পার।
মানুষের জীবনে দেখেছি মোটামুটি তিনটে চাওয়া, অর্থ-ক্ষমতা-জ্ঞান। আমার একটি বেশি, রস। সেই আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র যে বাকি তিনটিকে অনায়াসে উপেক্ষা করা যায়। সেই রস এই ভৌম জগতে অলৌকিক। বেঙ্গালুরুর কর্পোরেট দুনিয়ায় কল্পনাতীত তা। প্রথম প্রথম হাঁফিয়ে উঠতাম। কলকাতায় ফিরে আসার কথাও কি ভাবিনি? বাস্তবিক আমাকে যিনি এই সংকটে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনি ধ্যান না, গীতবিতান। অবাক হয়ে বুঝেছিলাম একের ধ্যানে অন্যের শান্ত হয়ে যাওয়া, সেটাও সম্ভব। ভারতবর্ষের অবতার পুরুষদের আবির্ভাবের যে ইতিহাস, অথবা কাব্যের যে লৌকিক প্রয়োজনীয়তা, তার প্রতি আজ আর কোনো সন্দেহ নেই তাই। উপলব্ধি করলাম সমস্ত প্রাণীর শরীরে যে জীবনী শক্তি সেই জীবনীশক্তির সঙ্গে সূর্যের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাভাষার সম্পর্ক তাই। দিনের প্রথম আলোয় প্রকৃতিতে যেভাবে জেগে ওঠে নবীন স্পন্দন, সেভাবেই বেঙ্গালুরুকেও আমার খুব একটা খারাপ মনে হলো না আর।
আমাদের শরীরে বৈশ্বানর নামক এক অগ্নি আছে। প্রচলিত ভাবে যাকে আমরা জঠরাগ্নিও বলে থাকি। শরীরের যাবতীয় স্থূল শক্তি যা, তার সঙ্গে আমাদের আত্মশক্তির সম্পর্ক ঘটায় তা। অস্তিত্বের এই কেন্দ্রীকরণ, স্থূলের সঙ্গে আত্মের এই যে সংযোগ ঘটানোর জন্যেই একে আমরা ‘বিশ্ব’ উপাধিতে ভূষিত করি। লৌকিক ভাষার যে স্থূল আলাপচারিতা তাকে অতিক্রম করে আমার ভিতর যে আমি বসে আছেন, আমার প্রকৃত আত্মীয় যিনি, তাঁর সঙ্গেও যে বাংলাভাষায় কথা বলা সম্ভব, এই আবরণ উন্মোচিত হয় প্রথম সম্ভবত রবীন্দ্রনাথেরই লেখাতে। তাঁর কাব্যই এই সংযোগ ঘটায়, তাই তিনি বিশ্বকবি। নইলে আমার মতনই আরও কত কত জন তো বৈখরী-মধ্যমা-পশ্যন্তী-পরা করে বৃথাদিনক্ষয় করে যাচ্ছিলাম রোজ। ব্রহ্মবান্ধববাবু যখন রবীন্দ্রনাথেরই কবিতা থেকে শব্দটি তুলে নিয়ে তাঁকে ডেকেছিলেন ‘বিশ্বকবি’ এই কথা নিশ্চয়ই তাঁর মনে আসেনি।
প্রবাসে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় স্বজন আমার অন্তত আর কেউ নেই। তিনিই আমাকে এক অর্থে পোষণ করে চলেছেন রোজ। আত্মানুভূতি তথা এই প্রকাশময় জীবনকে জানার তিনিই আমার টেক্সটবুক, তিনিই মেডিজি। ভাষার অবতার?