“বিকেলের বুক চিরে চলে গেছে ঝকঝকে হাইওয়ে। পথচারী হলুদ দাগের বাইরে হাঁটে”। একটু আলাপ করার ইচ্ছা হলে, গিয়ে কথা বলে আসি। শুধাই
– ‘যাচ্ছেন কোথায়’?
– “ সম্প্রতি শহরে একটা বৈদ্যুতিক চুল্লি বসেছে। দেখে
আসি কী তার কার্যকারিতা। কি সে পোড়াতে পারে?
কী তার পোড়াতে কষ্ট হয়? ঋণ করে আনা এই বিশ্বব্যাঙ্কের বিকালে
কী তার দহনের বিবেচ্য বিষয়?”
– “যদি সে শুধুমাত্র মাংস পুড়িয়ে শ্লাঘা বোধ করে, যদি সে
নিছক একটা নিটোল ছাইয়ের গঠন আমাদের দেয়,”
– “তবে তার সাথে দেখা করে লাভ নেই।
– সঙ্গে নিলেন না কাউকে?
– সঙ্গী!“যারা আমার ক্লান্তি ও কবিতার সহচর”!
বুঝলাম এই সাহচর্যকে পাথেয় করেই তিনি পথিক। মৃত্যুর মৃত্যু নেই জেনে বেড়িয়েছেন খোঁজ করতে “আজও মানুষ গাছে গাছে লেখে প্রিয় নাম, / ক্ষমা চায়; কিন্তু কার কাছে?” এক সূক্ষ্মতম ইঙ্গিত। এক দারুণ অভিঘাত ফেলা সংকেত। ক্লু? কে জানে!
“চলো হে চক্রবর্তী,”
– কোথায়?
– সম্প্রতি শহরে যে বৈদ্যুতিক চূল্লী বসেছে, চলো দেখে আসি
কী সে পোড়াতে পারে? কী তার পোড়াতে আজও কষ্ট হয়?
জীবন আমাদের ফেলে রেখে চলে গেছে প্রায় তিন কুড়ি বছরের পার। চিতার ঝক্কি এবং টিটোয়েন্টির উন্মাদনার কথা মাথায় রেখে, ধীরে ধীরে চিতা থেকে চিমনির দিকে ক্রমশ গড়িয়ে গেছি আমরা।আর যেহেতু“চিতা সাজানোর উপরেই দহনের যাবতীয় সাফল্য নির্ভর করে থাকে”, কানে কানে কিংবা সোচ্চারেই অভিজ্ঞ পাটুনির থেকে পথচারী শুনে ফেলেন সেই চাতুরী। হয়ত বুঝে যান সহজতা ও সহজলভ্যতার মাঝে রয়েছে এক অনন্ত দুপুর। তবু সৃষ্টির উর্ধস্রোতা গ্রাফ তা যে করেই হোক জড়িয়ে রয়েছে নাড়ীতন্ত্রের সাথে। তিনি বারবার কান পেতে শোনেন আপন প্রসব পীড়া। আর তারপর এক ব্যাতিক্রমী দর্শন যা ধীরে ধীরে নেমে আসে আপন বিষাদময় নাভিতে। এই তো তার অভিযান।
“বিকেলের বুক চিরে চলে গেছে ঝকঝকে হাইওয়ে। পথচারী হলুদ দাগের বাইরে হাঁটে।
শ্রান্ত পোষাক তার এলোমেলো করে যায় আশ্চর্য মারুতি, যা থেকে ক্ষণমাত্র চোখে পড়ে
ফরসা হাত, পলার রক্তাভ আলোড়ন”।
– কী মনে হয়, সমাজ না সময়?জাপানি না চায়না?
সে শুধু বিড়বিড় করে বলে- “ আসতে গেলে ভালো হত, সামনে
আমাদের বাচ্চাদের স্কুল।
এই বিষণ্ণতার কোনো ব্যাকরণ কৌমূদী নেই। নেই কোনো নিয়ম কানুন। এই গতিশীল থেকে গতিময় হতে চাওয়া, উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হতে চাওয়ার মাঝে, উঁচু উঁচু স্কাইস্ক্রেপার গুলি, আমাদের শেষমেশ পাশাপাশি বসবাস করে কারা এই বিষয়ে উন্নাসিক করে তোলে। জীবন যেখানে সত্যিই একটা রেস, সেখানে তিনি আগলে রাখেন আপন ঐতিহ্য। স্কুল! গ্লোসাইনের মেয়েটিকেও তিনি জিগ্যেস করেন “তুমি কি আমাকে আর পাঁচজনের চেয়ে অন্য চোখে দেখো?”আক্ষেপ করেন “যদি দেখো/ তবে কেন সিগারেট মুখে নিয়ে আমাকে ঊড়ে যেতে দেখে
কোনোওদিনও নিষেধ করোনি,”। কিংবা যা তিনি বিশ্বাস করে এসেছেন এতদিন। সেই বিশ্বাসগুলির স্মরণ আর এইভাবেই এই ইঁদুর দৌড় থেকে তাকে সজ্ঞানেই মুক্ত রাখতে চাইছেন তিনি। কে জানে তিনি কোন সাগরে ডুব দিয়ে পেতে চাইছেন কোন সাগরে ঠাঁই!
– মশাই, সচেতন, অবচেতন বা অসচেতনতা, তিনটেই কীভাবে যেন কীভাবেই গুলিয়ে গুলিয়ে যায়। আলাদা করে চেনা যায় না। আপনি পারেন?
– কে জানে ভাই, রাত্রির বেলা “বাসনকোসনের শব্দ শুনে উঠে বসি। সারা ঘর খাবারের গন্ধে ভরে আছে।
এতখানি স্পষ্ট নয় যে কাউকে দেখাব…
ডাইনিং টেবিল ঘিরে জটলা করছে দু-চারটে মানুষ। ভোরবেলা
ভাঁড়ারের দিকে ছুটে যাই। দু-চামচ গুঁড়ো দুধ, এক খাবলা চাল, দু চারটে আলু যেন কম কম লাগে”।
– সাবকনশাস!
– ওই লোকটিকে দেখছো? ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝে যে খুলেছে একক সেলুন?
– হ্যাঁ।
– ভোর থেকে রাত তার শুধু নিজেকেই প্রসাধনহীন
করে যাওয়া; মুছে ফেলা জন্মদাগ, মুছে ফেলা
সামাজিক উল্কির চিহ্নগুলি। আর কিছু নয়।
দর্পণ ক্ষয়ে যায়-দর্পণে রক্ত এসে লাগে।
এইসব দেখে তার বিগতজন্মের বিস্মৃত ভাস্কর্যের
নারী অকস্মাৎ বহুদিন পর সারি সারি পর্যটকের
চোখের সম্মুখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
– অসচেতন!
– ওই পাতার পাহাড়টিকে দেখছো?
– হ্যাঁ।
– বাগান সাফাই হলে দাদাবাবু, গড়ে উঠল পাতার পাহাড়। এ পাহাড়ে গুহা নেই,
পর্যটন নেই, ক্লান্তিকর উচ্চতা নেই। ভেঙে ফেলতে চাইলেই দাদাবাবু, অনায়াসে
ভেঙে ফেলা যেত। তুমি তো দেশলাই ছুড়ে বলেছিলে আগুন জ্বালাতে। কিন্তু
সেই মধ্যশীতে আমি বারুদের পা’দুটি ধরে বলেছিলাম- “শোনো, শোনো
অসংখ্য পাতার মধ্যে কাদের রান্নার শব্দ ভেসে আসে! ঐ শোনো, হাতা ও খুন্তির
আর্তনাদ! দেখ, কালো রোগা একটা মেয়ে, অবিকল আমাদের শব্দগাঁওয়ের মনে হয়!
উনানের চারপাশে বৃক্ষস্থবির কয়েকটি শিশু বসে আছে।
শোনো হে বারুদ, মেয়েটি নিজেকে বোধহয় ক্ষুদার্ত শ্যেনপক্ষীর
ঠোঁটে তুলে ধরবে, তুমি শুধু দেখো’’-
‘কী বলব দাদাবাবু, জল দেখলাম আমি বারুদের চোখে!’
– সচেতনতা!
– দেখো, ‘পাতার পাহাড়ে এসে জ্বলে উঠল বিকেলের আলো’।
নিজস্ব অন্তরাত্মার ইনসাইডার বলেই হয়ত তাকে সব সময় এক আউটসাইডারের চরিত্রে পাই। সমস্ত শব্দই তার রক্তমাংসের। তবু কোনো নির্দিষ্ট একটি পাত্রের আকারে তাঁদের উপলব্ধি করতে চাওয়া নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বাইরের তো নন। ‘অন্ধ ভিক্ষুকের হাতে রাজার পার্টটি দিয়ে সরে এসে’ যে নির্জনতায় তিনি বসে থাকেন, তার কোনো পোস্টাল অ্যাড্রেস নেই। অন্ধকারে হাতড়ে ফেরেন মঞ্চ, হাতড়ে ফেরেন সিংহাসন। যে চোখ দিয়ে খোঁজেন তাকে আয়না ছাড়া দেখতে চাইলে জ্বালা করে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুই তার নজর এড়ায় না। ‘এবছর পৃথিবীতে গোধূলি পড়েছে খুব’ এই সুক্ষ্ম অব্জারভেশন নিয়েও তিনি আক্ষেপ করেন, “অক্ষম দর্জি আমি, পদে পদে জরিপে ভুল করে শহর ও গোরস্থান মিশিয়ে ফেলেছি”। হাড় হিম হয়ে আসা বোধ হয় একেই বলে।
হলুদ দাগের বাইরের পথচারীর সামগ্রিকতার সাথে মিশে আছে অব্জেক্টিভিটি। নিজস্ব ব্যক্তি সেন্টিমেণ্টকে ছাপিয়ে সমস্ত কল্পনা এক বিমূর্ততার দিশা খুঁজতে ব্যস্ত। এই কল্পনার ভিতরে চিনত্মা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, চরাচরের সম্পর্ক তাকে দিয়েছে কাব্যের নতুন হদিশ। হাজার বছরের ইতিহাস তাকে করেছে সমৃদ্ধ। তাকে করেছে রূটেড। প্রত্যেকটি কবিতার সাথে সময়ের, কবিতার যে সময়কাল তার সাথে মশারির বাইরের ঘরটির, সেই ঘরটির সাথে সমাজের, কবিতার অভ্যন্তরের যে সমাজ তার সাথে মানবমনের এক অদ্ভুত যোগাযোগ যেমন তাকে করেছে মসৃণ, তেমনই করেছে রহস্যময়। প্রত্যেকটি ঘরের সাথে প্রত্যেকটি ঘরের সম্পর্ক আসলে নিজের মধ্যেই তৈরী করেছে এক ভুলভুলাইয়া। একবার সেখানে হারিয়ে গেলে কবিতাহত হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।
“বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে আমার অন্ধ দুঃখটি। হয়তো কেউ একদিন
তাকে হাত ধরে তুলে দেবে দিগন্তগামী একটি বাসে। যেখানে পকেটমার
হইতে সাবধান কথাটি লেখা নেই। কারণ বাসটি সম্পূর্ণভাবে
ঈশ্বরপোষিত এবং কোনো ব্যাঙ্কের শাখায় দায়বদ্ধ নয়”।
(পর্যটন/পৃঃ ৩৯)
অদ্ভুতভাবে ব্যক্তি সেণ্টিমেন্ট দিয়ে শুরু হওয়া একটি বাক্য যখন কবিতার দিকে গড়িয়ে যায়, কেমন করে যেন সৃষ্ট সেই পরিস্থিতিনিজস্ব আবেগটিকে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই সরাসরি না বলে উল্টোদিকের মানুষটির মানসিক সাড়া জাগিয়ে দিতে পারে। এখানে কেউ নিস্তব্ধ নয়। কিন্তু এই প্যাটার্ন অদ্ভুত ভাবে পারে আপনাকে নিশ্চুপ করিয়ে দিতে। এখানে কবি কোনোভাবেও গোধূলির বা খসড়া খাতার কাছে দায়বদ্ধ নন।
প্রথম পাতার ‘ভোর’ ফিরে ফিরে আসে পরের কবিতাগুলিতেও। একই গতিবেগ নিয়ে মুখোমুখি ফিরে আসে ‘বিকেল’। শ্মশান বা গোরস্থান এখানে জীবনমুখী। এই সমস্ত কিছু তিনি আপডেট করে রাখেন তার ‘পাশবই’তে। তার স্বগত উচ্চারণ কবিতাটিকে নিজেই একটি অব্জেক্ট করে তোলে, যা কম্পোজিশনের সমস্ত ফ্যাক্ট, বক্তব্যকে ছাপিয়ে পাঠকের বা শ্রোতার মনে তাঁর নিজস্ব সামাজিক অবস্থানঘটিত মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এই যন্ত্রণা সকলের ক্ষেত্রে যতটাই আলাদা ঠিক ততটাই এক।
ইদানিং প্রায় রাত্রে মা আমাকে ডেকে বলে-‘দেখে রাখো, এই সাতখানা পাশবই,
সমস্তই নমিনি তোমার’। আমি শুধু দেখি মা যেন মশারির বাইরে
চলে যাচ্ছে ক্রমশ।
স্বপ্নের ভিতরে কে যেন ঝনাৎ শব্দে ছুড়ে দেয় একগোছা চাবি।
একমাত্র মা-ই জানে কে কোন চাবিতে খুলে যায়।
এখন ভোরের আলোয় ভাসছে মার চুল। ঘুমন্ত মুখে রামধনুর
সাতটি রঙের একটি, পাশবই-এর পাতাগুলি, উড়ছে হাওয়ায়। (পাশবই/পৃঃ২০)
নিজের আমিত্ব কে বারবার সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে, প্রকাশ পেয়েছে তার বৃহৎ আমি।
কোনো একটি লাইন দিয়ে নয়। প্রত্যেকটি লাইন এখানে মিলে মিশে রচনা করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা। তাই আলোচনা করতে গেলে গোটা কবিতাটিই তুলে ধরতে হয়। নাহ কোনো বিশেষ ইজমের চর্চা নয়। কেবল চেতনার কাছে নিবিষ্ট হয়ে আত্মসমর্পণ করা।
সামগ্রিক কাব্যটি ব্যক্তি কবিকে যতটা প্রকাশ করে। ঠিক ততটাই রাখে লুকিয়ে। ব্যক্তি কবি কেমন, বা ঠিক এইরকম জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ তার চেতনা বারবার হয়েছে অন্তর্মূখীন, নিশ্চেতন আবার একই সাথে পরাচেতনার মধ্যে দিয়েছে ডুব অতলে। বিস্তার করেছে ইন্দ্রজাল। যেভাবে যাদুকর একটি জ্যন্ত মানুষের প্রথমে গলা কেটে দেন, আর তারপর পরক্ষণেই তাকে জ্যন্ত ফিরিয়ে আনেন স্টেজে সেইভাবেই মুগ্ধ হয়ে উঠি বারবার এর প্রতিটা পাতায়।
‘ভূমিকম্পের পটভূমি’ কবিতাটি একমাত্র মার্টিন স্করশিশের ‘দ্য বিগ শেভ’ শর্ট ফিল্মটির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু এক মিনিট, কেবল ওইটুকুই বাকিটা
এক বিছানায় আমরা কাটীয়েছি সুদীর্ঘ জীবন। আজ অকস্মাৎ মধ্যরাত্রে
তার দাড়ি কামাবার শব্দে আমার গভীর ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম অতিকায় রেজারে
সে তুলে ফেলেছে মৌখিক অভিব্যক্তিগুলি, ত্বকের বহুমাত্রিক আবরণ।
তার শেষ অশ্রুপতনের শব্দে কেঁপে ওঠে রিখটার স্কেল, নদীপাড়ের মা।
দেখি, ঘরময় ছোটাছুটি করে ভয়ার্ত আয়না লুকোবার জায়গা খুঁজছে।
(ভূমিকম্পের পটভূমি/পৃঃ২৯)
খুব মজা করে বললে তিনি আসলে বলটি বারবার আপনার কোর্টেই পাঠিয়ে দেন। এবার আপনি কেমন খেলবেন, সে আপনার ব্যাপার। নিজেকে অসহায় লাগে। এর চেয়ে বেশি কিছুই না।
ইতিহাস সচেতনতা, কাল সচেতনতাই সেই মূল সূত্র এই কাব্যের যা তাকে অতীত ও বর্তমানের সাথে সংযোগ ঘটিয়েছে। এখানে তিনি প্রবলভাবে একজন ইম্প্রেশনিস্ট।
এমন একটি কাচের অশ্রু আমি তৈরী করেছিলাম, তুখোড়
অশ্রুচোরও যা দেখে ভয় পেত। এমন একটি আয়না, যা
মূলত হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়ার মুহুর্তে কুৎসিত হয়ে
গিয়েছিলেন শাহজাদি।
আজ দশচক্রের শহর আমাকে মিরাক্যল দেখাবে বলে ডেকে আনে।
মনে পড়ল, পৃথিবীর যাবতীয় কারুকাজ, শিল্পের মহড়া
একদিন নিতে পারতাম, একা।
আজ এই লোকটা আমার কাছে দর হাঁকছে ফুল প্রতি চল্লিশ ডলার!
বলছে ‘এ পয়সা আপনার হাতের ময়লা আছে মালিক’
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে টাকার স্পর্শেন্দ্রিয়, স্তম্ভের ভাস্কর্য, হেলানো মিনার,
ছোটো ছোটো চোখে বৃহত্তর মানুষের মুখ।
লোকটি আশরফি চেনে, অশ্রু চেনে না।
(ঈশা খাঁ/পৃঃ ৪১)
ম্যাজিক, চমক, রহস্য, ইতিহাস সবকিছুই এখানে ঊর্ণনাভ বিস্তার করেছে। আটকে পড়েছে তাতে ‘ঈশা খাঁ’, ‘প্রজাপতি’ কিংবা ‘ইয়েতির মুখ’। প্রতিটা শব্দকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে আরও বলয়। আরও ঘোর। যেভাবে আলো বিস্তার করে। সেভাবেই। ছায়া।
জনৈকা বৌদি অন্ধকার ছাদ থেকে আমাকে দেখাচ্ছিলেন রাত্রির আকাশ।
তার নিঃশ্বাসের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে মনে হল একটি স্নিগ্ধ, ফরসা হাত যদি
এইভাবে অমোঘের দিকে প্রসারিত হত তবে…
নীচে স্খলিত কালপুরুষের আর্ত চিৎকার শোনা গেল-
শিকারি কুকুরের চীৎকারে ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছিল রাত্রির আকাশ।
(সমাপতন/পৃঃ১৮)
– আচ্ছা, কারও কিছু এসে যায় তাতে? কারও কিছু এসে গেছে কি?
– আমার অনেক কিছু এসে যায়, প্রিয় ডাস্টবিন, যদি তুমি আমাদের অন্ধত্বের কথা
ভুলে যাও; যদি মনে করো সমস্ত জঞ্জাল আমি ইচ্ছাকৃত জমিয়ে তুলেছি।
– ওটা কি?
– সর্বনাশ।
বিকেলের বাস থেকে এক সুন্দর সর্বনাশকে এই সময় নেমে আসতে দেখি। গোটা শহর দেখে। পথচারী বিড়বিড় করেন-
– ছেলেটিরও জেনে রাখা ভালো, আজ নয় কাল,
তাকে মৃত ফারাওয়ের সাথে যেতে হবে। সোনাদানা, কণ্ঠহার
অশ্ব অথবা অশ্বেতর জীবনের ভার, দাসদাসী এই সব নিয়ে…
নিরবধি বয়ে যাচ্ছে সময়। কাল। কাল থেকে মহাকালের দিকে হেঁটে চলেছেন পথচারী। এভাবেই ক্রমশ জন্ম নিতে দেখি একরোখা একটি মানুষকে। হলুদ দাগের বাইরে তার চলাচল। পিঠে রুকস্যাক। নামচা বাজার থেকে প্রতিবেশী শেরপার কাছে জেনে নেয় পাঠক্রম, জেনে নেয় মৃত্যুতালিকা। কোথাও পলাশ ছিল, কোথাও বা প্রেম… অথচ
…একজন প্রৌঢ় কবি ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়ে
দেখছেন কবিতাগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে কলকাতার দিকে…
প্রত্যেকটি পদক্ষেপে বদলে বদলে যায় তার গন্তব্য। তিনি, তার এই তার বেড়িয়ে পড়া, এই সমস্ত জার্নির কোথাও না কোথাও একটা না পৌছাঁনো আছে। “বিকেলের বুক চিরে চলে গেছে ঝকঝকে হাইওয়ে। পথচারী হলুদ দাগের বাইরে হাঁটে”। একটু আলাপ করার ইচ্ছা হলে, গিয়ে কথা বলে আসি। শুধাই
– যাব রঞ্জন ক্লিনিক। সেখান থেকে বইমেলা।
– খালি হাতে যাবেন? মিষ্টি নিয়ে যান…
– “আমি সেই ওয়াগন ব্রেকারের হাতফেরত মালগাড়ি, যার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই”। এই বলে তিনি এগিয়ে গেলেন, আর আমি এই ‘গোধূলির ধারাভাষ্য’ টুকে রাখতে গিয়ে দেখছি-
“হাইওয়ে পার হয়ে যাচ্ছে একটা পাগল।
রাস্তার পাশে…একটি মাইল-স্টোনের উপর
…তাকে পেচ্ছাব করতে দেখছি”।
*’ছাপাখানার গলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত