মিথ্যেকে আধার করে সত্যের খোঁজ, অভিনয় এমনই এক খেলা

Share this

অভিনয় ও চলচ্চিত্রাভিনয়/সম্পা: গোপা সেনগুপ্ত/সুজন প্রকাশনী/মূল্য ১৮০টাকা

অভিনয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও জটিল কলাগুলির মধ্যে অন্যতম। সিনেমার মতো একটি আঙ্গিকে সে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায়। অথচ এই ‘অভিনয় করা’ কথাটা বললেই প্রাথমিকভাবে আমরা যা বুঝি তা হল ‘মিথ্যে আচরণ’। উত্তর প্রদেশের ‘নৌটঙ্কি’ বা মারাঠি শব্দ ‘তামাশা’ বা ‘জেন ওয়াই’-এর শব্দ ‘ড্রামাবাজি’। প্রত্যেকটি কথা আমরা ‘মিথ্যাচার’ বা ‘ন্যাকামো করা’ প্রসঙ্গেই ব্যবহার করে থাকি। সত্যি করেই অভিনয়ের সঙ্গে এই মিথ্যাচারের একটা অসাধারণ সম্পর্ক রয়েছে। ম্যাজিকের মতোই অভিনয়ও এমন এক শিল্প যেখানে দর্শককে আদ্যন্ত বোকা বানানো হয় দর্শকদেরই অনুমতিক্রমে। এবং এই বোকা বানানোটা কতটা ‘ক্ল্যাসিক’ হয়ে উঠল তার উপরেই সে পার্ফর্মেন্স-এর সফলতা নির্ধারিত হয়! তবু অভিনয় মিথ্যা নয়। এ এমন এক খেলা যে মিথ্যাকে আধার করে বাস্তবের মাটিতে এক অন্য সত্যের সন্ধান করে। গোপা সেনগুপ্ত-র সম্পাদনায় সুজন প্রকাশনী-র ‘অভিনয় ও চলচ্চিত্রাভিনয়’ ঠিক সেরকমই এক বই, যা শিল্পের ‘সপ্তম সি’ চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে, মঞ্চের সঙ্গে তুলনায় অভিনয়ের শৈল্পিকতার সন্ধান করে।

“প্রেমের প্রতি আমার মোহ ও সুদূরতার যে দ্বৈত অনুভূতি তা অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজন লোক কী করে অভিনেতা হতে পারে? এটা আমি কখনো বুঝতে পারি না। অভিনেতাদের একই সঙ্গে ভীষণ ও সরল বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। আর তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায়শই তিক্ত। তাদের সঙ্গে কথা আমি বলি না, সেটা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এই জন্য যে সব সময়েই, রুগ্ন শিশুর মতো তাদের অভয় দেবার প্রয়োজন হয়। আত্মপ্রকাশে অক্ষম বলেই অবশ্য তারা অভিনেতা হয়েছে”                                                                             -গোদার/চলচ্চিত্রাভিনয় : একটি শৈল্পিক প্রক্রিয়া/ পৃ-১৯

যেকোনো সিনেমায় ভালো অভিনয়ের প্রারম্ভিক শর্তটাই হচ্ছে(একজন পেশাদার অভিনেতার ক্ষেত্রে) চরিত্রের সঙ্গে অভিনেতার আত্মিক সংযোগ, চলচ্চিত্রের তথা মাধ্যমটির সঙ্গে তাঁর অ্যাসোসিয়েশন এবং পরিচালকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সমঝোতা। ধীমান দাশগুপ্ত, এই বইয়ের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, বইটির জন্য একটি মুখবন্ধে তথা প্রথম প্রবন্ধেই পাঠককে তাই এই বিষয়ে কনশাস করতে পরিচালক-অভিনেতার এমনই এক শৈল্পিক কলহময় সহবাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই আকালের দেশে সিনেমার সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তিনিই তো একমাত্র পথপ্রদর্শক । আর এই প্রবন্ধে সিনেমার ইতিহাসের সূত্র ধরে ধরে তিনি জানাতে চেয়েছেন ভালো অভিনেতাদের নাম ও তাঁদের কর্মপদ্ধতি, অভিনয় প্যাটার্ন। গ্রেটা গার্বো, চ্যাপলিন, বাস্টার কীটন ও ইনগ্রিড বার্গম্যানের পাশে ভারতবর্ষ থেকে তাঁর এই শর্টলিস্টে একমাত্র নাম আসে মাধবী মুখোপাধ্যায়-এর(তাঁর একটি নিবন্ধও রয়েছে এই বইটিতে রবীন্দ্রচরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে)। কিন্তু একজন দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে অভিনয় প্যাটার্নের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি হারিয়ে ফেলেন অভিনেতাদের অভিনয়ের ঘরানাটিকে; ক্রিটিকের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে এই বিচার করলে তা নিশ্চয়ই উল্লিখিত হতো। পরিচালকের সঙ্গে অভিনেতার সম্পর্কের কথাগুলিও যেহেতু তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, তাই এ লেখাতে সে জড়তাটিও প্রকাশ পায়। পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি এক্কেবারেই ভুলে যান পাশ্চাত্য অভিনয়শৈলীর প্রধান পুরুষ কনস্টানটিন স্তানিস্‌লাভ্‌স্কি-কে। আলোচনায় একবারের জন্য হলেও তাই লি স্ট্র্যাসবার্গ-এর মেথড অ্যাক্টিং-এর কথা উঠে আসে না। বইয়ের শেষ লেখাটিতেও যখন তিনি ‘ডিজিটাল অ্যাক্টিং’-কে ‘ফটোশপ অ্যাক্টিং’ বলে অভিহিত করেন তখন তো ইরফান, রাজকুমার রাও, লিওনার্দো ডি-ক্যাপ্রিওর জন্য খুব হতাশা হয়। প্রথম প্রবন্ধটিতে তাঁর আলোচনায় তিনি পরিচালক-অভিনেতার মিথষ্ক্রিয়ার কথা প্রসঙ্গে ‘টাইপেজ’ তত্ত্বে জোড় দিয়েছেন। কিন্তু ‘টাইপেজ তত্ত্ব’ ফিল্ম অ্যাক্টিং-এর সঙ্গে যতটা না জড়িত, বরং তাঁর চেয়ে বেশি জড়িত ফিল্ম মেকিং-এর সঙ্গে। ঠিক যে সময়ে দাঁড়িয়ে আইজেন্সটাইন এই টাইপেজ তত্ত্বের কথা বলেছিলেন, ততদিনে এডিটের ফান্ডামেন্টাল কাটগুলো গ্রিফিথ আবিষ্কার করে ফেললেও, অভিনয়ের ক্ষেত্রে তখনও সিনেমা, স্টেজ অ্যাক্টরদের উপরই নির্ভরশীল। ফলত তাঁকে অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় ‘কুলেশভ এফেক্ট’-এর উপর। তাই পুডভকিন ও তাঁকে নন-অ্যাক্টারদের খোঁজে বেরোতে হয়, যাঁরা “‘পার্ট প্লে’ করেন না, প্লে করেন নিজেকেই”; ফলে তাদের পার্ফরমেন্সগুলোকেও শেষমেশ অভিনয় বোধ হয় বলা যায় না। কারণ ঠিক তাঁর পরের সিনেমাতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নন-অ্যাক্টারদের আর ডাকা হয় না অভিনয়ের জন্য। অবশ্য একথাও ভুললে চলবে না যে আইজেন্সটাইনের সমস্ত ছবিই আসলে একেকটি প্রোপাগাণ্ডা।বইটিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল লেখাটির অনুল্লেখ বিভ্রান্তিকর। পুডভকিনের ফিল্ম টেকনিক বিষয়ে একটি অসাধারণ বই আছে। তারই একটি সেগমেন্ট, ‘ফিল্ম ডিরেক্টর ও ফিল্ম মেটেরিয়াল’। এই সেগমেন্টেরই অন্তর্গত একটি প্রবন্ধ ‘ফিল্ম ডিরেক্টর অ্যাণ্ড দ্য অ্যাক্টর’ আলোচ্য বইটিতে ‘পরিচালক ও অভিনেতা’ শিরোনামে অনূদিত। প্রবন্ধটি আজও তাঁর ‘সিনেমায় এনসেম্বল’ কথাটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ; অভিনয়কে শুধুমাত্র একটি ফিল্ম মেটেরিয়াল বলতেও তিনি দ্বিধা করেননি। কিন্তু অনুবাদের সময় অভিনয়-সেন্সের অভাবে অনেকসময় হারিয়ে যায় আসল কথাটি। যেমন ‘এক্সপ্রেসিভ মুভমেন্ট’ হয়ে গিয়েছে ‘প্রকাশময় গতিময়তা’; যা তৈরি করে কনফিউশন। অভিনয়ের ‘গতি’ ও ‘অভিব্যক্তিপূর্ণ অঙ্গসঞ্চালন’ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আবার সের্গেই আইজেন্সটাইন-এর ‘ফিল্ম সেন্স’ শীর্ষক বইটির প্রথম প্রবন্ধ ‘ওয়ার্ড অ্যাণ্ড ইমেজ’ টূকরো টুকরো অনূদিত হয়েছে এই বইতে ‘অভিনেতার কাজ’ নামে। কেন? ব্যাপারটি কি এথিক্যাল? পাঠকের সঙ্গে তঞ্চকতা করা হচ্ছে না তো? আবার চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনীকে গোর্কির উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করা উৎপল দত্তের ‘অভিনেতার আত্মজীবনী প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটিই বা  কীভাবে ‘অভিনয় ও চলচ্চিত্রাভিনয়’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়! চেরকাসভ লেখাটির ক্ষেত্রে অবশ্য এমন এডিট চোখে পড়ে না। তাঁর ‘নোট্‌স অফ অ্যান সোভিয়েত অ্যাক্টর’ থেকে অনূদিত লেখাটি মূলের খুব কাছাকাছি ও সহজ বলেই মনে হয়েছে। তাই আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক যেসমস্ত অভিনেতারা মঞ্চের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকতে সাহস পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্য চেরকাসভের এই লেখা আজও একটি সদুত্তর হতে পারে।জোসেফ ফন স্টার্নবার্গ-এর ‘মঞ্চাভিনয় ও চিত্রাভিনয়’ প্রবন্ধটি একটি মুগ্ধতা। অনেক কথা জানা যায় যোগেশ দত্তের ‘বিবর্তনের পথ পরিক্রমায় মূকাভিনয়’ প্রবন্ধটি পড়ে। আর প্রাপ্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘অপু থেকে গঙ্গাচরণ’। ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’, ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’ এবং ‘অশনি সংকেত’ এই ছ’টি ছবির নেপথ্য কাহিনী তথা অভিনেতা হিসেবে তাঁর হোম ওয়ার্কগুলি পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন লেখক। নতুন অভিনেতাদের জন্য যা অবশ্য পাঠ্য। নিজের অভিনয় জীবনের তেইশ বছর পেড়িয়ে এসে তিনি এই লেখাটিতে হাত দিয়েছিলেন। ফলে অজস্র অ্যানেকডোটস্‌-এ ভরা এ লেখা। “অভিনয়ের কতটা মানুষের অভিজ্ঞতা লব্ধ, কতটাই বা কল্পনার সৃজিত— আবার কতটা তা প্রাক্তন স্বভাবসিদ্ধ সংস্কার, এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক চলতে পারে। আমি শুধু দেখেছি হুঁশিয়ার থাকলে জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো অভিনয়ে অনেক সময় কাজে লাগানো যায়”। পি.সি.সরকার তো ‘জাদুবিদ্যায় অভিনয়ের ভূমিকা’ আলোচনা করেছেন। অভিনয়ের ভাষা প্রসঙ্গে মনে করিয়েছেন মানুষ কথা বলতে শিখেছে পরে, আগে শিখেছে অভিনয়। এই আলোচনায় ফ্রেট্যাগের নাটক ও তাঁর ইন্দ্রজালের ক্রম-পরিনতির তুলনামূলক ছকটিও চমৎকার। তবু “সব শিল্পের মতোই নীতি একটা স্থির থাকলেও রীতি পালটে পালটে যায়”। এই একটি অনুভবেই কুমার রায় অভিনয়ের শৈলী নিয়ে যাবতীয় সারাৎসার রচনা করে ফেলেন। নিজের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘অভিনয়ের রীতি-নীতি’ আলোচনা করে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন এমন একটি সত্যে যা উইনিভার্সাল। ওই যে প্রথমেই লিখেছিলাম, মিথ্যেকে আধার করে একটি সত্যের খোঁজ, অভিনয় তো এমনই এক খেলা। ম্যাজিক।    

১. পরিচালক ও অভিনেতা-ভি.আই.পুডভকিন-পৃ ৩২।
২. অপু থেকে গঙ্গাচরণ-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-পৃ ৫১।

Share this
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shopping Cart
Media
উপন্যাস (Novel)
কবিতা (Poetry)
গল্প (Short Stories)
গোপনবাসীর কান্নাহাসি
নিবন্ধ (Articles)
নাট্যশাস্ত্র (Natyashastra)
নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics)
অন্যান্য (Other)
error: Content is protected !!
Scroll to Top
Enable Notifications OK No thanks
×