শো শেষ হয়েছে কয়েক মুহূর্ত হল। হাতে ঈশিতের দেওয়া কার্ডটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌরব, যখন সিদ্ধার্থদা এসে ওকে জানায়, ‘রণিদা তোকে খুঁজছে’। ‘আসছি’, এই উত্তর দিয়েও কৌরব কিছুটা সময় নেয়। কার্ডটাকে নিজের পার্সে রাখে। আলোচনায় ইতি টেনে ঈশিত এগিয়ে যায় গ্রিনরুমের দিকে। আর ওর এখনই রণিদার সামনে যেতে ইচ্ছে করে না। সে ফোন করে তাঁকে বলে, ‘স্টেজের কাজ শেষ করে আসছি’। কৌরব এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে। সেখানে টেকনিশিয়ানরা সমস্ত সরঞ্জাম ইতিমধ্যেই ফ্লাই ও অন্যান্য জায়গা থেকে খুলে মঞ্চের উপর নামিয়েছে। যাবতীয় প্রপ্স মঞ্চের উপর সাজিয়ে বসেছে বসেছে পিন্টু। কোনটা কোন ব্যাগে যাবে সেই নিয়ে বরাবরের মতন কনিফিউসড। কৌরব ওর পাশেই পড়ে থাকা সেট হিসেবে ব্যবহৃত একটি কাঠের ব্লকের উপর এইসব তদারকি করতে বসে। একটি শো শেষের পর এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একটিও প্রয়োজনের জিনিস যদি হারিয়ে যায়, তাহলে পরের শো ঝুলে যাবে। পকেট থেকে একটা চেকলিস্ট বের করে মেলাতে থাকে।
এই সুপারভাইজারি দলে ওর আগে করত বিস্ময়। আর কৌরব তখন ছিল বিস্ময়েরই এক্সিকিউটিভ। ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ফ্যাক্ট সত্যি আর মিথ্যা কোনটা কি গুলিয়ে গুলিয়ে যায়। পর্ণাদি ও রণিদার ডিভোর্সের কারণ নিয়ে ছড়ানো গুজবকেও সত্যি বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎই পিন্টু ওকে ‘আচ্ছা পেমেন্ট কি কলকাতায় গিয়ে দেবে, না মাইশোরের শো এর পর পাবো জানো?’ জিগ্যেস করলে ওর সম্বিৎ ফেরে। থিয়েটার করতে এসেই কৌরব এটা বুঝতে শিখেছে যারা মোটামুটি একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে, তাদের কাছে জীবন যতটা চ্যালেঞ্জিং, ওর নিজের কাছে সেরকম নয়। তাকে অন্তত পেট ভরানোর বা থাকা-পড়ার চিন্তাটা করতেই হয় না। শো শেষ হলে কখন পেমেন্ট আসবে তার জন্য ভাবতে হয় না। তবে অস্তিত্বের লড়াই মানে কেবলই তো আর রক্তমাংসে টিকে থাকা নয়। অর্থনৈতিকভাবে চিন্তামুক্ত হলে মানুষের কাছে সামাজিক পরিচয়ের যে অস্তিত্ব তাকে রক্ষার করার লড়াই চলেই আসে। থিয়েটার ওকে সেই পরিসর দেয়, নিজেকে মেলে ধরার। ওর অর্থনৈতিক ব্যাকগ্রাউণ্ডকে অনেকেই ওর বৌদ্ধিক চর্চার জন্য সুবিধে বলে বিবেচনা করলেও, কৌরবের নিজের মনে হয়, ওর স্বচ্ছল বড়ো হয়ে ওঠা, ওকে সমাজের একটা বিশাল অংশের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যেটা কৌরব চাইলেও কোনোওমতেই আর দূর করতে পারবে না। হয়ত এই চিন্তাটাই ওর আচরণের দুর্বিনয়কে অনেকটা কমিয়ে এনেছে। সে পিন্টুর দিকে চেয়ে না সূচক মাথা নাড়ায় ও প্যাকিং এর কাজ শেষ করে। চূড়ান্ত ইরিটেশন নিয়ে ডিনার করতে যায়। সেখানে ব্যুফে সিস্টেমে সকলকে লাইন দিয়ে খাবার নিতে দেখে সে।
ক্যাওস যখন খুব স্বাভাবিক, তখন এই সুর, সুশৃঙ্খল ব্যাপার-স্যাপার, সন্দেহজনক বলে মনে হয়। সে দেখে একেকটি প্লেটে উঠে আসছে একই সঙ্গে রোস্টেড চিকেন, ও ইডলি কারি। ধর্মরাজ দিনের শেসে শাকান্নের পরামর্শ দিয়েছিলেন। একথা এই টিমের কমবেশি সকলেই জানে। কৌরব কেবল একটি মশলা দোসা ও চাটনি নিয়ে আলাদা হয়ে যায়, সম্বর কোনোদিনই ওর তেমন পছন্দের নয়। মায়ের কথা মনে পড়ে। একবার রুবির বাড়ি থেকে দোসা, সম্বর, ও এই সাদা চাটনি রান্না করে এনেছিলেন তিনি ওর জন্য। খেতে খুব ভালো হলেও কৌরব মুখে উল্টো কথা বলে। মা-কে ব্যথা দিয়ে কেমন আরাম হয় মনের ভিতর। এই দেড় মাসের জার্নিতে এক-দুবার দিদার সঙ্গে ফোনে কথা হলেও মা-এর ফোন সে তোলেনি, রিং ব্যাকও করেনি। হাতের প্লেটের গরম দোসাকে ঠাণ্ডা বলে মনে হয় ওর; একটু পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে।
দলে তখনও সবসময়ের মেম্বার নয় সে। মাঝে মাঝে আসে। অবশ্য মাঝে মাঝে মানে প্রায়শই। রণিদা চান যে সমস্ত রিহার্সালেই সে উপস্থিত থাকুক, কিন্তু পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে পর্ণাদি বকাঝকা করেন। সেদিন কর্ণ-কুন্তি সংবাদের মহড়া চলছে, যে ‘মহাভারত’ নাটকটা নিয়ে ওরা দেশের এই বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই নাটকেরই একটা অংশ হিসেবে। রিহার্সাল রুমে সে চুপচাপ বসেছিল। রণিদা করছিলেন ডিজাইন। ঈশিত করছিল কর্ণের চরিত্র ও পর্ণাদি করছিলেন কুন্তীর অভিনয়। আর কখন যে সেই টেক্সটের সাবটেক্সট গলে কৌরব নিজে ঢুকে পড়েছে ওই সিনে বুঝতে পারেনি। পার, পিসি, ফ্রেনেলের আলোতে কী প্রত্যক্ষ করছিল সে, ‘ঘোর যুদ্ধফল’? জীবনের অনাগত ভবিষ্যৎ বুঝি! পর্ণাদিকে দেখে সেদিনও ওর মায়ের কথা মন পড়ছিল খুব, ওর জীবনে যাঁর ভূমিকা একজন অনাত্মীয়া হিসেবে। ঈশিত তখন চিৎকার করে উচ্চারণ করছে, “জয়লোভে যশলোভে…বীরের সদ্গতি…”। সুশ্রুত ধরেছে দেশের একটা গদ। বাজিয়েই চলেছে, বাজিয়েই চলেছে… আর সব থেমে যাওয়ার পর রণিদা শুনলেন কৌরব আপন মনেই উচ্চারণ করছে, “সূর্য ডুবে যান সন্ধ্যায়, প্রত্যুষে তিনি আবার নতুন। কিন্তু আমরা লুপ্ত সময়ে ফিরে যেতে পারি— শুধু কল্পনায়, কখনো কোনো অপ্রস্তুত মুহূর্তে”। ওর কান্না পায় আর কান্না পেলে এক দু’ফোঁটা গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে। ওইটুকুই। রণিদা আলতো করে বলেন, “এই জন্যেই তোর নাম কৌরব!” আবার শুরু হয় রিহার্সাল, নাটকের পরের মুহুর্তের। কৌরব রিহার্সালের মধ্যে আর থাকতে না পেরে বাইরে এসেছিল। সেদিন থেকেই দলে ওর রেগুলার যাতায়াত। হাতের দোসাটা খেতে আর ইচ্ছে করে না আর। বমি বমি পায়। যা দেখে সিদ্ধার্থদা বলে, ‘নারকেল তেলের জন্য হচ্ছে’, রণিদা বলেন ‘অ্যাসিডিটি’, আর দলের বাকিরা এই বিষয়ে উন্নাসিক থাকে, তেমন পাত্তা সে কারুর থেকে পায় না। কাউকে সে বলে না কিন্তু ওর নিজের থেকে বারো বছরের ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। সে বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকে। মা তার নাম রেখেছে নীড়, আর সন্তানের নাম রাখা নিয়ে এইবার দাদুর কাছে তিনি কোন সাজেশনই নেননি।
ভোরের আলো ফুটেছে আকাশে। কতটা পথ তারা এসেছে, আর কতটা পথ বাকি কৌরব জানে না। ঘড়িতে তখন সময় সাড়ে চারটে। ঈশিত জানলায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসের সামনের কাঁচে ড্রাইভার একবার জল ছিটিয়ে ওয়াইপার দিয়ে মুছে নিল। কৌরবেরও চোখে একটা ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা নিতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে করল বাসের দরজা খুলে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাওয়ার। কিন্তু উপায় নেই। এর চেয়ে বরং নিজের সঙ্গে নিজেরই একটা নির্বিরোধী অবস্থানে কীভাবে যাওয়া যায় এখন সেই প্রশ্ন মাথায় আসছে। আজ থেকে দুবছর আগে, গ্র্যাজুয়েশনের পর সে চেয়েছিল প্রথাগত একাডেমিক সিস্টেম থেকে মুক্তি। পরিষ্কার হয়ে বলতে গেলে যেকোনো সিস্টেম থেকেই একটা ফান্ডামেন্টাল মোক্ষ। অচেষ্টার মধ্যে দিয়ে যাকে পাওয়া যায়। তার বদলে সে এসে পড়েছে এমন এক সিস্টেমে, যা মানুষের কাঁচা অনুভূতিগুলোকে ময়দার মতন চটকায়, দুহাতে মাখে। হিপিদের মতন বাঁচতে পারলে ভালো হত এই কথা একবার মনে হয়। একসময় সেও মেয়েদের প্রেমে পড়ত। সোহিনীর কথা মনে পড়ে, সেও যদি হয়ে উঠত ওর প্রকৃতি, তার কাছেই নিজের জাহাজ ভিড়িয়ে দিত সে। কিন্তু জীবনে তার এমন কোন নারীই আসেনি যার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। কিংবা হয়ত নারীদের প্রতি ততটা আকর্ষণ সে কখনই বোধ করেনি। একবার আড়মোড়া ভাঙে কৌরব। আর দুখানা ফোর্স ট্রাভেল মিনিবাস ওর যাবতীয় রেসিং থটস ছিঁড়ে এগিয়ে যায় আরেকটু দক্ষিণে।
ডিনার শেষ করে কৌরব আসে রণিদার ঘরে। সেখানে তখন দলের সিনিয়র মেম্বারদের সঙ্গে একটা মিটিং চলছে। রণিদা ওকে একটা চেয়ারে বসার নির্দেশ দিয়ে বলে,
– দল একটা নাটকের ফেস্টিভ্যাল করবে সেপ্টেম্বর নাগাদ। আমাদের সকলের মিলিত ইচ্ছে, তোর একটা নাটকের প্রিমিয়ার হোক সেই ফেস্টিভ্যালে ।
– লেখা?
– নাহ, ডিরেকশন।
পরিশিষ্ট
আজ থেকে আরও দুবছর পর, ধরে নিন, বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই পরেই, একদিন হামফারা পাবলিশার্স-এর দপ্তরে পাণ্ডুলিপি নিয়ে যখন আলাপ আলোচনা চলছে, কৌতূহল বশতই প্রকাশক অপূর্ব ওকে “আচ্ছা কোন নাটক ডিরেক্ট করেছিলে?” এই প্রশ্ন করলে কৌরব উত্তর দেয়, “ডঃ ফাউস্টাস।”
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.
“অথচ একটি কাগজের উপর একটি কলমের কতখানি চাপ থাকলে সেই অলৌকিক জিঘাংসা কে নান্দনিকতায় মুড়ে ফেলা যায়….”👌
জীবনের চড়াই উতরাই গুলিকে নিখুঁত ভাবে মেলে ধরার মতো পটুত্ব শিল্পীর কাছে যেমন আনন্দের পাঠকের কাছে তেমন আনন্দোপভোগের l
শুধু অসাধারণ শব্দ টি বোধ হয় যথার্থ নয় l