জানলার বাইরে আনমনে তাকিয়ে কৌরব। আউটস্পোকেন জ্যোছনা নির্লজ্জের মতো বেআবরু। গাছগুলো মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে হন্যে। আকাশে খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা জ্বলন্ত উল্কা, যেন চাঁদের সঙ্গে এক চূড়ান্ত সম্ভোগে তারার সমস্ত বাঁধন আলগা হয়ে লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। নিজেকে ওর চাঁদের সেই ঔরস বলে মনে হয়। তারার গর্ভে যে জন্ম নেবে বুধ রূপে। ওর গাড়ি এগিয়ে চলে। নির্লজ্জ জ্যোছনার ভিতর এগিয়ে চলে। সেই ভেজা আলোর ভিতর কৌরব পিছলে পিছলে যায়। গাড়ির ভিতর হিন্দী গানের কোলাহল। গাড়ির ভিতর থমথমে নীরবতা। কে যেন ওর সুষুন্মার দ্বার খুলে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস সমস্ত স্মৃতিকে উড়িয়ে নিয়ে প্রবেশ করেসেখানে। মনে পরে,‘তুমি কে?’, সেই প্রশ্নটা, যা রণিদা ওকে ওর প্রথম ওয়ার্কশপে জিজ্ঞেস করেছিল। যেখানে কবীরকে সেই প্রথম কোনো প্রোডাকশনের জন্য নয়, শুধু নিজের জন্য বাজাতে শোনে সে। কী রাগ? কী রাগ বাজাচ্ছে ও? চিনতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে ওই সুর নিংড়ে নিচ্ছে ওর সমস্ত পরিচয়, প্রতিরোধের কোনো শক্তি নেই আর। হা ঈশ্বর, এই কী আর্ট? সারাদিন পরিশ্রমের পর অর্জিত ঋক কী এখানেই বিলিয়ে দিতে হয়? রণিদার প্রশ্নে কৌরব নিরুত্তর থাকে। সমস্ত কথায় জবাব দেওয়া যার স্বভাব, জীবনের অনেক প্রশ্নে সে-ই নিরুত্তর হয়ে পড়ে! এভাবেই বড়ো হয়। জানলায় কাচের উপর ফোঁটা ফোঁটা জলীয় বাষ্পের ঝাপসা। আনমনে তারই বাইরে তাকিয়ে ছিল সে।
এস্ট্রোনমির স্বপ্ন ছেড়ে থিয়েটারের এই গ্ল্যামার জগতে ওর এসে পড়া যে একটা ঘটনা, এটা অন্তত আজ থেকে দুবছর আগে কৌরবের নিজেরই মনে হয়েছিল। তখন সে আশুতোষ কলেজে ফিজিক্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র, আর বিস্ময়, ওর পাড়ার বন্ধু, রণিদাকে গ্রুপে অ্যাসিস্ট করে।এই বিস্ময়ই একদিনকৌরবকে ওদের রক্তকরবী নাটকটা দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। লিটল ম্যাগাজিনেযারা লেখালেখি করে তার নাটকও দেখতে যায়। একটা টিকিট সে বিস্ময়ের কাছে ফ্রি-তেই পেয়েছিল, কিন্তু আরেকটা সে কেনে সোহিনীর জন্য। সোহিনী ওর প্রাক্তন প্রেমিকা, যার সঙ্গে এই নাটক দেখে বেরোনোর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেদিন নাটক দেখে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার গ্রিন রুমে গেছিলো সে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা করতে। বিস্ময়ই ওকে রণিদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। মধ্য চল্লিশের, মধ্য হাইটের একটু স্থূল চেহারার ভদ্রলোক। সব্বাই ওনার সঙ্গে কথা বলছে বা বলতে চাইছে। তারই মাঝেবিস্ময় আলাপ করালো, “রণিদা, এ কৌরব, আমার বন্ধু। আশুতোষে পড়ে, ফিজিক্স অনার্স। ভালো লেখালেখি করে”। হা রবীন ঠাকুর, এর আগে যদি কোনোদিন বিস্ময় ওর লেখা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতো! যাই হোক এই প্রথম সে বন্ধুর মুখে নিজের লেখার সুনাম শুনে একইসঙ্গে আনন্দিত ও অপ্রস্তুত হয়। শৌনক সরকারকে ও চেনে। পরিচয় নেই, কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় সিভিল সোসাইটির মুভমেন্টে মিছিলে হাঁটতে ও মিডিয়ায় বাইট দিতে এঁকে দেখেছে। তখন শৌনক সরকার-র পরিচিতি অত ছিল না, পরিবর্তনের সরকার আসার পর যতটা হয়েছে। রণিদাকে দেখে ও নমস্কার করতেই, রণিদা হেসে ওঠেন ও গলা জড়িয়ে ধরেন, “আমি তোমারই প্রাক্তনী বন্ধু, গলায় এসো। নাটক কেমন লাগল?” এরকম আকস্মিক আলিঙ্গনে, কৌরব কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল, এরকম অভ্যর্থনা অন্তত আশা করেনি অবশ্যই। “ভালোই, তবে নাটকটা যেহেতু রক্তকরবী তাই মঞ্চে বাহুল্য একটু বর্জিত হলে ভালো হতো”, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে ফেলে কৌরব। এমন সৎ ও কটু প্রতিক্রিয়া শৌনক সরকার প্রত্যাশা করেছিলেন কি? কিছুক্ষণের জন্য, ওকে টিকিট দিয়ে ডেকে বিপদ করলো, এ সন্দেহ বিস্ময়ের মাথার ভিতর ভর করেছিল কিনা, তা ঘটনার হঠকারিতায় বোঝা যায়নি। তবে কৌরব এ মন্তব্য করে ফেলেছে এবং সেটা ও ফেরত নিতে পারবে না। এটাই ওর স্বভাব, পরে আর আফসোস করে না এ নিয়ে। সেদিনই একটু মাঝরাত্তিরে যখন বাড়ির ছাদে, মোবাইলে সোহিনীর সঙ্গে তুমুল ঝগড়ায় সে ব্যস্ত, একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনটা সে রিসিভ করে। একথা সে কথার পর রণিদা ওকে নিজের বাড়িতে পরের দিন লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানান ও ঠিক তার পর থেকেই ও এই থিয়েটারে জড়িয়ে পড়ে। ওর বাবা এর জন্য ওর দিদা-দাদুকে দায়ী করে, শ্বশুর-শ্বাশুরি-ননদ-জা দায়ী করে মা-কে, দিদা বলেন ‘আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি ওর নামে রেখে যাব’, দাদু কিছুই বলেননি, কারণ বলার জন্য তিনি আর এ জগতে ছিলেন না। তবে প্রতিবেশীরা কৌরবের কেরিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধান কৌরব যদিও আজ অবধি করে উঠতে পারেনি।
মনের ভিতরে শুধু একটা ভালো লাগা নিয়ে কৌরব, সেদিন দলে যোগ দিতে নয়, বস্তুত গেছিল আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই। সেদিন শৌনকদা ওকে অনেক প্রশ্ন করেন। কোথায় বাড়ি, কী করে অবসরে ইত্যাদি সাধারণ প্রশ্ন ছাড়াও, কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন। সবগুলোরই সাদামাটা উত্তর দিলেও, ও কেন দাদু-দিদার সঙ্গে থাকে একথা বুঝিয়ে বলতে পারেনি। বুঝিয়ে বলতে পারেনি, কৌরব নামটার কারণ। দাদু দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন, জানে না। সে ছোটদের মহাভারত পড়েছে। দিদার কাছে গল্পও শুনেছে কিছু। তবে মহাভারতের বিষয়ে সবচেয়ে বিশেষভাবে ও যা জানে তা হলোএটাই যে ওর বাবা ধৃতরাষ্ট্র! ‘অন্ধ, অন্ধ, কিছুই দেখে না, বোঝে না’, রাজ্যের একজন আমলার নামে এরকম মন্তব্যের কারণে যে কারুর জেল হতে পারে, আর সে যে কেবল ভদ্রলোকের ছেলে হওয়ার কারণেই বেঁচে যাচ্ছে, সব শুনে, ওর মায়ের এমনটাই মতামত।
এর আগেও ওকে ওর এই নাম নিয়ে এক শিক্ষক স্কুলে প্রশ্ন করলে সটান সে উত্তর দিয়ে দেয়, “আপনি কি মেডিজি দেখে পাশ করেছেন!”এক্ষেত্রে সে এতটা রুড হলো না। কারণ শৌনকদা ওকে সরাসরি এই প্রশ্নটা করেননি। কেবল নিজের মনেই ভাবতে থাকেন, “একটা পরাজিত পক্ষের নামে কেন কেউ তার সন্তানের বা নাতির নাম রাখবে!” এই ধন্ধের সমাধান করার জন্যই কৌরব নিজেই মহাভারত পড়া শুরু করে। প্রথমে রাজশেখর বসু, তারপর একে একে দেবদত্ত, সিদ্ধান্তবাগীশও মোটামুটি। সেটা যে খুব কার্যকরী পথ ছিল এমনটা না হলেও, কাজের কাজ ওর মহাভারতটা পড়া হয়ে যায়। আলাপ হয় পর্ণাদির সঙ্গে। শৌনক সরকারের স্ত্রী ও দলের মুখ্য অভিনেত্রী। গতকালকের শো-তে নন্দিনী চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেছিলেন। স্বভাবে গম্ভীর, সেদিন কৌরবের প্রতি খুব বেশি ইন্টেরেস্ট তিনি না দেখালেও এই কৌরবই একসময় তার সব দুঃখ শেয়ার করার জন হবে। লাঞ্চের পর শৌনক বাবু ওর অনেকগুলো লেখা কবিতা শোনেন। তাঁর লাইব্রেরী দেখে কৌরব চমকে যায়। সেখানে হাজারখানেক বই। লাইব্রেরী দেখেই ও প্রথম আকর্ষণ বোধ করে রণিদার প্রতি। ওর নিজের কাছে নিজের পড়ুয়া ইমেজটা ভেঙে পড়ে। আর সোহিনীর সঙ্গে ঝগড়ায় ভেঙে যাওয়া মনটাকে আশ্রয় দেওয়ার একটা জায়গা সে খুঁজে পায়।
বিকেলে এক এক করে দলের অন্যান্য সদস্যরা আসতে থাকে। বিস্ময় কৌরবকে দেখে অবাক হয়, খুশিও হয়, এতটাই যে সন্ধেবেলা রিহার্সাল শেষে সে কৌরবকে একটা গোল্ড ফ্লেক কিনে খাওয়ায়। সেদিন ওরা অন্য একটা নাটকের রিহার্সাল করছিল, ‘অভিনেত্রী’ নামে, শৌনক সরকারের নিজেরই লেখা। রিহার্সাল চলতে চলতে হঠাতই রণিদা কৌরবকে সকলের মাঝে ডেকে নেন ও নতুন একটা সিন ভেবে ফেলেন। কীভাবে এক্সিকিউট হবে সেটা কৌরবকে বুঝিয়ে অভিনয় করে দেখাতে বলেন। এর আগে কখনও কৌরব অভিনয় তো দূর অভিনয় করার কথা ভাবেওনি। যে শিল্প একার তাতে ও স্বচ্ছন্দ; যে শিল্প দলের, সেখানে সে কতটা উজবুক তা টের পায় একঘর লোকের সামনে ছড়িয়ে। রণিদা ওকে ডেকে নেন ও সকলকে ডিজাইনটা কী হবে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বিস্ময়কে অভিনয় করে দেখাতে বলেন। কৌরব রণিদার পিছনে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেআর ভাবে খুব কী প্রয়োজন ছিল এটার! সে তো একবারের জন্যও বলেনি যে সে অভিনয় করতে চায়! কারুরই চোখে চোখ রাখতে হেসিটেটেড হয়। বিস্ময় খুব স্মার্টলি বিষয়টা সকলের সামনে প্রস্তুত করে। হাততালিও পায়। কৌরব এতে আরও মুষড়ে পড়ে। মনখারাপও হয়। ভিতরে ভিতরে আগের দিনের করা মন্তব্যের কারণে ওর লজ্জা হতে থাকে, এসময়, রণিদা ওর দিকে না তাকিয়েই ওকে বলেন, “চিন্তা করিস না কৌরব, আগামীকাল মঞ্চে সিনটা তুইই করবি!”
কৌরবের আর কিছু বলার থাকেনা। রণিদা যেভাবে ওর মন পড়ে ফেলেছিল, বিস্ময় বলেছিল সেটা নাকি শুধু মা ও সন্তানের মধ্যেই হয়। রাত্তিরে বাড়ি ফিরে আসার আগে, কৌরব আগের দিনের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলে, রণিদা সকলের সামনে ঠাট্টা করেন যে সে অভিনয় করতে হবে ভেবে রিগ্রেট করছে নাকি! অথচ আড়ালে বলেন যে, নাটকের আর্টখানি এক বিশেষ শিল্পীর করা। সম্মানের খাতিরে, পছন্দ না হলেও, শিল্পী অপ্রসন্ন হবেন ভেবে তিনি তা ব্যবহার করতে বাধ্য হন। তবে, “তুই তোর মনের কথা বলেছিস। আর তোর মনে হওয়াটা শুধু জাস্টিফায়েডই না বরং সত্যিও। তাই সরি বলার কোনো কারণ নেই। আর শিল্পের বিষয়ে কাউকে ভুল পরামর্শ দেওয়া বা ভুল মন্তব্য করা অন্যায়। এতে তাঁর ক্ষতিই হয়।”
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
Disclaimer
This is a work of fiction. Names, characters, places, and incidents either are the product of the author’s imagination or are used fictitiously. Any resemblance to actual events, locales, or persons, living or dead, is entirely coincidental. The views and opinions expressed in this novel are those of the characters and do not necessarily reflect the official policy or position of any agency, organization, or entity. Reader discretion is advised.