নাট্যশাস্ত্র: ইতিহাস, ধারণা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পর্ব ৭)

Share this
natyashastra নাট্যশাস্ত্র

যত দিন যাচ্ছে, জানি না আর্থসামাজিক কারণে, নাকি স্বভাবজ, জীবনে প্রশ্ন বাড়ছে। উত্তরের জন্যও ঠিক ততটাই আকুলতা। অন্ধভক্তি অতএব কম। তার উপর তিনি বলেছেন যুক্তি ছাড়া কোনো কিছুকে মেনে না নিতে। চার নম্বর ব্লগে আমরা দেখেছিলাম নাট্যে তিনজনের অধিকার, কবি, নট ও সামাজিক। নট মানে অভিনেতা, কবি না হয় বুঝলাম রূপকের রচয়িতা তথা প্রচলিত নাট্যকার অর্থে, কিন্তু একইভাবে সামাজিক কথাটির অর্থ সোসাইটাল বা সোসাইটির মানুষজন বা নিছক মেম্বারস ধরে নেওয়ায় কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না না। অ্যারিস্টটল পোয়েটিক্স লিখেছিলেন কাব্যকে প্লেটোর সংশয় থেকে মুক্তি দিতে। সেখানে চর্চাটি কেবল শিল্পীর অর্থাৎ কবির। ভরতের কাছে তো শুধু নট বা কবি না, সামাজিকও নাট্যের সাধক। সামাজিক যদি রসের আস্বাদ নিতে না পারেন তাহলে নাট্যের ফলাফল কেবল পুঁথিগত হয়েই থেকে যায়, তাঁকেও তাই হয়ে উঠতে হয় সহৃদয়। তিনি দর্শক না, শ্রোতা না, তিনি প্রেক্ষক। প্রেক্ষক যিনি রসিক, নাট্যরসের মধ্যে তিনি পেতে চান ব্রহ্মানন্দের স্বাদ। রস তিনপ্রকার লৌকিক, অলৌকিক ও নাট্য। সেই আলোচনা পড়ে কখনও হবে খন। তবে যে প্রশ্নটা মনে জেগেছিল আমার এতক্ষণ সেটা এই, যে মুমুক্ষু নয়, তাঁকে তো জোর করে টেনে এনে বসানো যায় না। তাহলে কি সকলেই নয়, কেউ কেউ সামাজিক, আচার্যের আস্থা তাই?

মুনি ভরতের লড়াই শুদ্রত্বের বিরুদ্ধে, শিল্পের শুদ্রিকরণের বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতে দেখা যাবে আসলে এই লড়াই শূদ্রদেরই জন্য এবং শূদ্রদের দ্বারাই। যেকোনো শিল্পীই আমরা আসলে জন্ম নিই এই পৃথিবীতে শূদ্র অবতারে। নাট্যের চর্চা আমাদের বৃহৎ করে, ব্রাহ্মণ করে। সমাজ শব্দের ভিতর কোনো জাতি বিভাজন নেই। রসের আস্বাদ সবার জন্য। যে যাই বলুক না কেন সামাজিক শব্দটার এই বৌদ্ধিক প্রয়োগে ব্যক্তি আমি বেশ মজা পেয়েছি। তবে সামাজিক শব্দের অন্য একটি বিপদ থেকে আমাকে আসলে উদ্ধার করলেন বিদ্যাভূষণ মহাশয়।

গিরনারে প্রাপ্ত প্রথম পর্বতলিপিতে সমাজ শব্দের দুটি অর্থ পাওয়া যায়।

প্রভু হিত্যবম্‌ ন ছ সমাজ কটব্যো বহুকং
দোসং সমাজম্‌হি পয়স্তি দেবনং পিয়ো পিয়দসি রাজা

এবং

অস্তি পিতুএ কচা সমাজা সাধুমতা দেবানাং পিয়স

বিভিন্ন বৌদ্ধসাহিত্য তথা জাতকে সমাজ শব্দের নাট্যাভিনয় অর্থে প্রয়োগ দেখা যায়। রঙ্গমঞ্চের অর্থ ছিল সমাজ মণ্ডল। এখন যদি অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয়কেই উদ্ধৃত করি তাহলে “অশোকের লিপির প্রথম ছত্রে যে সমাজ শব্দ আছে – সেই সমাজে নৃত্য গীত ও অন্যান্য আমোদ লোকেরা পাইত, আর অশোক এই সমাজকে সাধুসম্মত বলিয়া মনে করিতেন।” বাৎস্যায়নের উল্লেখ করে বিদ্যাভূষণ মহাশয় আরও লিখছেন, “পক্ষান্ত বা মাসান্ত দিনে তখনকার প্রথানুসারে সরস্বতী মন্দিরের পূজারীরা সমাজের ব্যবস্থা করিবেন। অন্য স্থান হইতে অভিনেতারা আসিয়া অভিনয় করিবে। এই অভিনয়ের নাম ছিল – ‘প্রেক্ষণম’। …বাৎস্যায়নের উক্তি হইতে প্রমাণিত হইতেছে যে, সমাজই একরূপ নাট্যাভিনয়।” অর্থাৎ গোষ্ঠীবদ্ধ ‘প্রেক্ষক’ এক অর্থে ‘সামাজিক’, তাঁরা নাট্যের বিষয়, সম্বন্ধ, প্রয়োজন এবং অধিকারী সম্বন্ধে অবহিত। অর্থাৎ আজকের দিনে ক্রিটিকবর্গ।

এবার নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে প্রবেশ করা যাক।

প্রণম্য শিরসা দেবৌ পিতামহমহেশ্বরৌ ।
নাট্যশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি ব্রহ্মণা যদুদাহৃতম্ ॥ ১॥

সমাপ্তজপ্যং ব্রতিনং স্বসুতৈঃ পরিবারিতম্ ।
অনধ্যায়ে কদাচিত্তু ভরতং নাট্যকোবিদম্ ॥ ২॥

মুনয়ঃ পর্যুপাস্যৈনমাত্রেয়প্রমুখাঃ পুরা ।
পপ্রচ্ছুস্তে মহাত্মানো নিয়তেন্দ্রিয়বুদ্ধয়ঃ ॥ ৩॥

যোঽয়ং ভগবতা সম্যগ্গ্রথিতো বেদসম্মিতঃ ।
নাট্যবেদং কথং ব্রহ্মন্নুৎপন্নঃ কস্য বা কৃতে ॥ ৪॥

কত্যঙ্গঃ কিম্প্রমাণশ্চ প্রয়োগশ্চাস্য কীদৃশঃ ।
সর্বমেতদ্যথাতত্ত্বং ভগবন্বক্তুমর্হসি ॥ ৫॥

উল্লিখিত প্রথম অধ্যায়ের প্রথম কারিকাটি আসলে নাট্যশাস্ত্রের মঙ্গলাচরণ যেখানে গুরুস্মরণ পুর্বক ভরত নাট্যশাস্ত্রের যাবতীয় বিষয়ের কথন করেছেন (অনুবাদ- আমি আমার মাথা নত করে দেবদ্বয় পিতামহ ব্রহ্মা ও মহেশ্বর শিবকে প্রণাম জানাই। এরপর আমি ব্রহ্মা কর্তৃক উদাহৃত নাট্যশাস্ত্র প্রকৃষ্ট রূপে বলব বা ব্যাখ্যা করব)। সংস্কৃত থেকে অন্য যেকোনো ভাষায় অনুবাদ করার অবকাশ কম, বরং তাঁর ভাবসম্প্রসারণ করা যেতে পারে। আপাতত এই পর্বে মঙ্গলাচরণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ কম, কিন্তু এটুকু উল্লেখ করা যায় যে এই মঙ্গলাচরণের উল্লেখ, নাট্যশাস্ত্রকে ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরায় আস্তিক দর্শনের মধ্যে স্থান দেয়। আস্তিক অর্থাৎ বেদপন্থী (প্রচ্ছন্ন বা পারম্পরিক যেকোনো উপায়ে), এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সঙ্গে আস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি পদ্যে এই কারিকাগুলির বাংলা পয়ার ছন্দে একটি ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছিলাম পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে (কতটা সফল তা আপনারা বলবেন, যেকোনো ভুল সংশোধনযোগ্য)। প্রথম পাঁচটি কারিকার পদ্যানুবাদ এখানে দিলাম-

প্রথমে প্রণাম করি গুরুদেবদ্বয়,
প্রজাপতিমহাদেব থাকুন সদয়
অতঃ বলি শোনো যার নাট্যশাস্ত্র নাম,
ব্রহ্মামুখনিঃসৃত জগৎ প্রমাণ ।।
জপাচার ইতি ব্রত শেষ হলে পর,
রয়েছি সপরিবারে অনধ্যায়াসর
মহাত্মা আত্রেয় আদি অতিথি সকলে,
সবিনয়ে পাঁচ প্রশ্ন করে কৌতূহলে ।।
“ভগবান আপনি যে বেদের সমান,
গেঁথেছেন মালা করে এই মহাজ্ঞান
বিষয় সম্বন্ধ মেনে কোন প্রয়োজনে?
কেই বা অধিকারী এ দৈব আয়োজনে?
কত অঙ্গ? কী প্রমাণ? শেষ অভিপ্রায়,
যথাতত্ত্ব বলে দিন প্রয়োগ-উপায়”।।

অতএব আমরা বুঝতে পারছি ভরত বাকি চারটি কারিকার মাধ্যমে এখানে একটি পরিস্থিতির কথা বলছেন, যেখানে তিনি তাঁর আশ্রমে কোনো এক ছুটির দিনে (অনধ্যায়) জপাচার শেষ হলে যখন সপরিবারে(অর্থাৎ তাঁর সন্তানসম শিষ্যেরা সহ) রয়েছেন, তখন আত্রেয় প্রমুখ মুনিরা তাঁকে পাঁচটি প্রশ্নের মাধ্যমে সম্পুর্ণ নাট্যের বিষয়ে জানতে চান। আচার্য ভরত কবি, দ্রষ্টা; তাঁর একশ’ সন্তান নট, এবং যে মুনিরা এই প্রশ্ন করছেন (অবশ্যই নাট্যের পূর্ব-অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভব থেকে) তাঁরা প্রেক্ষক তথা সামাজিক। ভরতের এই একশজন শিষ্যের তথা সন্তানের পরিচয় পাওয়া যায় এই অধ্যায়েরই পঁচিশ থেকে চল্লিশ সংখ্যক কারিকায় এবং মুনিদের পরিচয় আমরা পাই নাট্যশাস্ত্রের শেষ ছত্রিশতম অধ্যায়ে। এখন যেহেতু এই মুনিরা পরিচিত তাঁদের সাধনার জন্য, তাই নাট্য কি যারা সাধক বা তাপস নন বা আমাদের এই সাধারণ গৃহীসমাজের জন্য নয়, এই সন্দেহ কেউ কেউ করতে পারেন। সেজন্য এই পর্বের শুরুতেই এই সন্দেহ দূর করে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।  

এখন এই পুরো পরিস্থিতিটিই কেমন যেন একটা প্রচলিত ডিরেক্টরস মিটের মতন না! যেন দর্শকেরা তথা ক্রিটিকরা নাটক দেখার পর ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করছেন তাঁর পরিবেশনা নিয়ে। মুনিদের করা পাঁচটি প্রশ্ন তাহলে কি ছিল?

১। নাট্যের কেন এবং কীভাবে উৎপত্তি হলো?
২। নাট্যের অধিকারী কে?
৩। কতগুলি অঙ্গ?
৪। প্রমাণ কী?
এবং
৫। প্রয়োগ কেমন?

এই পাঁচটি প্রশ্নের দ্বারা মুনিরা নাট্যবেদ সম্বন্ধে যথাতত্ত্ব জানতে চেয়েছেন ভরতমুনির কাছ থেকে। এবং তাঁদের অনুরোধ এও ছিল যে যদি কোনো প্রশ্ন তাঁরা করতে ভুলে যান, অধ্যয়নের সুবিধার্থে যেন তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই প্রশ্নেরও সমাধান করেন। গুরুসন্নিকটে এই শিক্ষালাভের পদ্ধতি উপনিষদিক। ভরতও তাই যোগ্য অধিকারীর নিকট নিজপ্রবৃত্তির তথা গুরুধর্ম রক্ষা করার খাতিরে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না করে তাঁদের এই কৌতূহলের সমাধানযোগ্য চেষ্টা করেন।

আচ্ছা, আমরা যখন স্ক্রিপ্ট অ্যানালিসিস করি বা চিত্রনাট্য লিখি তখন শুরুতেই স্থান-কাল-পাত্র ইত্যাদির উল্লেখ করি; কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে পাত্রের উল্লেখ আছে, কিন্তু কোথাও স্থান বা সময়ের কোনো উল্লেখ নেই। কারণ ভরত নাট্যশাস্ত্রে যে জ্ঞানের কথা বলছেন তা লৌকিক নয়। স্থান ও কালের সীমিত পরিসরে তাকে আটকে রাখা যাবে না। যা চিরকালীন, তাঁকে কীভাবে কেউ কোনো নির্দিষ্ট পরিসীমায় আটকে রাখবে? আর্কিওলজিক্যাল বা পুরাতাত্ত্বিক ইতিবৃত্তে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে সাইকোলজিক্যাল অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক এই ইতিহাস একটু খটমট বোধ হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন ইতিহাস ডারউইনের মতানুযায়ী কেবল শরীরের বিবর্তনই নয়, মানুষের চিন্তার তথা মানুষের মনেরও বিবর্তনের ইতিহাস। ডারউইন আর ফ্রয়েড এই দুজনের মিলিত পরম্পরায় ইয়োরোপ আজ নিজেদের সাইকোসোমাটিক (দেহমনস্তাত্ত্বিক) অতীত বোঝার চেষ্টা করছে, আর জীবনের এই দ্বৈততার প্রলয় ঘটিয়ে ভরত আমাদের তথা ত্রিলোকের এই পার্থিব অংশের মরজগতের অধিবাসীদের দিতে চান অদ্বৈতানন্দের রসের আস্বাদ, নাট্যের মাধ্যমে।

অন্যান্য পর্বগুলি এখানে

Share this
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shopping Cart
Media
উপন্যাস (Novel)
গোপনবাসীর কান্নাহাসি (Whispers of Laughter and Tears)
কবিতা (Poems)
গল্প (Short Stories)
নিবন্ধ (Articles)
নাট্যশাস্ত্র (Natyashastra)
নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics)
অন্যান্য (Other)
error: Content is protected !!
Scroll to Top
Enable Notifications OK No thanks
×