নাট্যশাস্ত্র তো কেবল নাট্যকলার উপযোগী কোনো হ্যান্ডবুক বা ম্যানুয়াল নয়, নাট্যশাস্ত্র আসলে একটি দর্শন যা নাট্যে পুরুষার্থের কথা বলে। যুক্তি তর্কে মনুস্মৃতিকে সরাসরি খণ্ডন করার সাহস ভরতমুণিই দেখান। শুধু তাই নয়, যে বিদ্যায় আমাদের সামাজিক পিরামিডের নিম্নবর্গীয়দের কোনো অধিকার ছিল না, সেই জ্ঞানে তাঁদের শিক্ষিত করেন। নটের তথা শিল্পীর পরিচয়কে তিনিই সমাজে বিশিষ্ট স্থান দেন। এবং নাট্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি যে কেবলমাত্র নাটকের কথা বলছেন তা নয়, তার আলোচনায় উঠে আসছে ভারতবর্ষের যত শিল্প, যত কলা সেই সমস্ত কিছুর বিজ্ঞান এবং যোগ।
ন তজ্জ্ঞানং ন তচ্ছিল্পং ন সা বিদ্যা ন সা কলা ।
নাসৌ যোগো ন তৎকর্ম নাট্যেঽস্মিন্ যন্ন দৃশ্যতে ॥ ১ | ১১৬॥
(সাধারণ অর্থ – এমন কোন জ্ঞান, শিল্প, বিদ্যা, কলা, যোগ, বা কর্ম নেই যা নাট্যে নেই)
তাই ভরত নিজেই একে সমাজের সর্ববর্ণের জন্য নিমিত্ত পঞ্চম বেদ বলে উল্লেখ করা করেছেন।
আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম অমরকোষ উল্লিখিত নাট্যের তিনটি পরম্পরার কথা। শিলালি, কৃশাশ্ব পরম্পরা নিয়ে আমরা কিছু আলোচনাও করেছিলাম। আজ এই পর্বে আমরা মূলত ভরতের নাট্যপরম্পরা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। ভবভূতি (অষ্টম শতাব্দীর সংস্কৃত নাট্যকার) ভরতকে তৌর্যত্রিকের সূত্রকার বলে উল্লেখ করেছেন। গীত, বাদ্য ও নৃত্যকে একত্রে তৌর্যত্রিক বলা হয়। মনুস্মৃতি এই তৌর্যত্রিককেই কামজব্যসন বলে উল্লেখ করেছেন।
মৃগয়াঽক্ষো দিবাস্বপ্নঃ পরিবাদঃ স্ত্রিয়ো মদঃ ।
তৌর্যত্রিকং বৃথাট্যা চ কামজো দশকো গণঃ ॥ ৭.৪৭॥
মৃগয়া + অক্ষঃ + দিবা + স্বপ্নঃ – শিকার, জুয়া, দিনে ঘুমানো
পরিবাদঃ + স্ত্রীয়ঃ + মদঃ – নিন্দা, নারী, এবং মদ্যপান
তৌর্যত্রিকম্ + বৃথাট্যা + চ – নাচ, গান, সংগীত, এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরা
কামজঃ + দশকো + গণঃ – কামনা থেকে উদ্ভূত, এই দশটি দোষ
অর্থ- শিকার, জুয়া, দিনে ঘুমানো, নিন্দা, নারী, মদ্যপান,
নাচ-গান, সংগীত, এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরা—
এসব দশটি দোষ, যা কামনা থেকে উদ্ভূত।
ভরত এর বিরোধিতা করেছেন নাট্যশাস্ত্র সংকলনের মধ্যে দিয়ে। ভরতের নাট্যশাস্ত্র কেবল নাচগান শেখায় না বা নাচ গানের উপদেশ দিয়ে শেষ হয়ে যায় না। তিনি নাট্যকে নটের ধর্ম বলে প্রতীষ্ঠা করেছেন। এবং একের ধর্মকে বিচার করার অধিকার অন্যের নেই। যাই হোক, তৌর্যত্রিকের যে সূত্রগুলি ভরত রচনা করেছিলেন তা এখনও আমাদের নাগালের বাইরে। আবার এই ভরত, আমাদের বর্তমান আলোচ্য ভরতই কিনা তাও জানার উপায় নেই। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে যেখানে আমরা শিলালির নটসূত্রের ও কৃশাশ্বের উল্লেখ পেয়েছিলাম সেখানে ভরতের নটসূত্রের কোনো উল্লেখ নেই; উল্লেখ নেই অমরকোষেও। নাট্যশাস্ত্র বার্তিক তথা ভরতভাষ্যের রচয়িতা নান্যদেবও ভরতকে সূত্রকার বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের শাস্ত্রকার ভরত ও সূত্রকার ভরত এক না অন্য আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু অভিনবভারতী (আগের পর্বে উল্লিখিত) -র উপর ভরসা করে চলতে পারি।
অন্যান্য পর্বগুলি এখানে
এইভাবে আরও পাঁচজন ভরতের উল্লেখ আমরা পাই। তারা হলেন বৃদ্ধভরত, নন্দীভরত, কোহলভরত, দত্তিলভরত এবং মতঙ্গভরত। নাট্যশাস্ত্রের মতে ব্রহ্মা স্বয়ং নাট্যবেদের স্রস্টা। অন্য পরম্পরায় নটরাজ শিব নাট্যবেদের প্রদান করেছিলেন নন্দিকেশ্বরকে। নাট্যশাস্ত্রে যদিও ভরত এই দুইজন গুরুর কাছেই পরম্পরাগতভাবে দীক্ষিত। আমাদের বর্তমান ভরত ও আগে উল্লিখিত পাঁচজন ভরত ছাড়া আরেকজন ভরতের উল্লেখ আমরা পেয়ে থাকি তিনি হলেন আদিভরত। সম্ভবত এই আদিভরত এবং বৃদ্ধভরত একজন ব্যক্তিই। শারদাতনয় (ভাবপ্রকাশন-এর রচয়িতা)-এর মতে এই বৃদ্ধভরতই আদিতম নাট্যবেদের ঋষি।
ভাবপ্রকাশনের মতে ব্রহ্মার কাছে পাঁচজন ঋষি নাট্যবেদের শিক্ষালাভ করেছিলেন, এবং ব্রহ্মা ‘নাট্যবেদং ভরত’ এই কথা উল্লেখ করায় নাট্যবেদ ভরতের নাট্যশাস্ত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়। এখন আমি এখনই কোনো পৌরাণিক আলোচনায় যেতে ইচ্ছুক নই। যদিও এই পৌরাণিক উল্লেখগুলি আমাদের আলোচনার একটি মডেল তৈরিতে পরে অবশ্যই সাহায্য করবে। তবু যে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আমরা এখনও পর্যন্ত এই আলোচনা করেছি, তাকে বজায় রাখাই ভালো। এবং ব্লগ আমাদের সামগ্রিক নাট্যশাস্ত্র আলোচনা করার পরিসর দেবে না। পরে কোন বই লেখার সুযোগ হলে বিস্তৃতভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। আপাতত আমরা ভরতের যে নাট্যপরম্পরার কথা বলছি সেখানে আরেকটি প্রামাণিক উল্লেখের প্রয়োজন আছে, নইলে এই আলোচনা অসমাপ্ত রয়ে যায়, আর তা হল, পঞ্চভরতম নামক একটি পাণ্ডুলিপি। পারসনাথ দ্বিবেদীর কথা অনুযায়ী পঞ্চভরতেও শারদাতনয় উল্লিখিত আদিভরত, নন্দিভরত এবং মতঙ্গভরতের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এই বইতে উল্লিখিত শেষ দুটি নাম শারদাতনয় কথিত নামের সঙ্গে মেলে না। আর সেই নাম দুটি হল হনুমৎভরত, এবং অর্জুনভরত। অর্জুনভরতের একটি পাণ্ডুলিপি এখনও পাওয়া যায়।
এইখানে এইবার একটু পিছন ফিরে দেখা ভালো, তথ্যের জটাজালে নইলে বুদ্ধিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। এই ব্লগটি লেখার মূল উদ্দেশ হল ভরতের নাট্যশাস্ত্রের অধিকারী হয়ে ওঠা; এবং সেই উদ্দেশে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের আগে ভারতবর্ষে প্রচলিত নাট্যপরম্পরাগুলির সম্বন্ধে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি অল্প। শিলালি ও কৃশাশ্ব এই দুই আচার্যের সম্বন্ধেও জেনেছি। তাঁদের পরম্পরা যথাক্রমে শিলালিন ও কৃশাশ্বিন এই দুই নামে পরিচিত ছিল এটা জেনেছি। আমরা আরও অনুমান করেছি প্রাচীন ভারতীয় থিয়েটারের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ধারা এবং প্রথা বিদ্যমান ছিল, যেগুলি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে বা একত্রিত হয়েছে। ভরত মুনির সময়ে এই শিল্পের গঠন এবং প্রথা সংহত হয়েছিল, কিন্তু পূর্বের অনেক কিছু ধারা এবং প্রথা হয় হারিয়ে যায় কিংবা পরবর্তীতে একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয় এমন ধারণাও আমাদের হয়েছে। ‘ভরত কে?’ এই আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ভরতের পরম্পরা তথা উত্তরাধিকার সম্বন্ধে জেনেছি। আমরা মহাভারত ও রামায়ণেও নাট্যের উল্লেখ পেয়েছি, যা নাট্যের প্রাচীনতাকেই প্রমাণ করে। এই প্রাচীনত্ব ও উত্তরাধিকার দ্বারা ভরত যে মনুস্মৃতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, এবং নাট্যশাস্ত্র যে ফাইনালি সামাজিক সংহতির কথা বলে তাও জেনেছি। পরের পর্বে আমরা আরেকধাপ এগিয়ে নাট্যশাস্ত্রের সমস্ত অধ্যায় ও মূল আলোচ্য বিষয়গুলি সম্বন্ধে আলোচনা করব।
সুন্দরভাবে বলা হচ্ছে যা সকলের বোধগম্য হবে।
ধন্যবাদ রাজীবদা
খুবই উপকারি এবং চমৎকার
ধন্যবাদ
সহজ পাঠ
সমৃদ্ধ , পরিপূর্ণ
ধন্যবাদ অরুণদা